হেমন্তের আকাশে চার নতুন অতিথি!
সূর্য উঠতে কিছুক্ষণ বাকি। পুব আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বসে থাকলেই দেখা যাচ্ছে ওই চার অতিথিকে। সূর্য উঠে গেলেই ফের হারিয়ে যাচ্ছে ওই অতিথিরা। তাদের দেখতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আরও একটা ভোরের জন্য।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ওই চার অতিথি আসলে চারটি ধূমকেতু। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলেন, ওদের নাম আইসন, লাভজয়, এনকে এবং লিনিয়ার। বছরের এই সময়টায় ধূমকেতু দেখাটা নতুন কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু একই সঙ্গে একই সময়ে চার-চারটি ধূমকেতুকে দেখার সুযোগ ছাড়তে চাইছেন না জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বেশি উৎসাহী ধূমকেতু আইসনকে নিয়ে। কারণ, সেটিকে খালি চোখে দেখা যাবে ভোরের আকাশে। পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের প্রাক্তন অধিকর্তা, জ্যোতির্বিজ্ঞানী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “২৮ নভেম্বর সূর্যের সব থেকে কাছে আসবে আইসন। ৫ ডিসেম্বর থেকে খালি চোখে দেখা যাবে তাকে। সব থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর।”
ভোরের আকাশে পুব দিকে জ্বলজ্বল করে শুকতারা। তাতে চোখের ভ্রান্তি হবে না তো? অমলেন্দুবাবু বলেন, “ওই সময় শুক্রগ্রহের থেকেও (শুকতারা) উজ্জ্বল দেখাতে পারে আইসনকে।” তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, ২৮ নভেম্বরের দিন সাতেক আগেও খালি চোখে ধরা দিতে পারে আইসন। |
টেলিস্কোপে চোখ শ্রী গৌরাঙ্গ গৌড়ীয় মিশন সেবাশ্রমের অনাথ
কচিকাঁচাদের। রবিবার ঘোলা সোদপুরে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়। |
আইসনকে নিয়ে মাতামাতির আরও একটি কারণ দেখছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, সাধারণত ধূমকেতুগুলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে। হ্যালির ধূমকেতু হাজির হয় ৭৬ বছর পর পর। এনকে সাড়ে তিন বছর পর পর ফিরে আসে। কিন্তু আইসনকে দেখা যাবে এই এক বারই। তাই তার উপরে নজর রাখার এই একবারই সুযোগ পাওয়া যাবে। ধূমকেতুর মধ্যে সৌরজগতের সৃষ্টির নানা তথ্য লুকিয়ে থাকে। আইসনও সে রকম কোনও তথ্য দিতে পারে কি না, সেই আশায় রয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
পরবর্তীকালে কেন আর দেখা যাবে না আইসনকে? অমলেন্দুবাবু বলেন, ৬ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট আইসন ধূমকেতুটি একটি অধিবৃত্তাকার কক্ষপথে চলছে। এর থেকেই পরিষ্কার, এই ধূমকেতুটি এক বারই দেখা দেবে। হ্যালির ধূমকেতু উপবৃত্তাকার কক্ষপথে চলতে থাকে বলে তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ফিরে আসে।
তবে এত উৎসাহের মধ্যে কিছু উদ্বেগের বিষয়ও রয়েছে। সঞ্জীববাবু বলছেন, ‘‘সূর্যের খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার ফলেই আইসনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি ভেঙে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে খালি চোখে একে দেখা যাবে না। টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে ভাঙা অংশগুলিকে আলোর মালার মতো লাগতে পারে।” অমলেন্দুবাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১১ সালে ইলিনিন নামে একটি ধূমকেতুকে নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। কিন্তু সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঙে যাওয়ার ফলে তাকে ঠিক মতো পর্যবেক্ষণই করা যায়নি।
আর তাই আইসনের প্রতিটি মূহূর্ত টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখে নিচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। লিপিবদ্ধ করে রাখছেন ল্যাপটপে। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষকেরা আইসনের গতিপথ নিয়মিত মেপে চলেছেন।
কিন্তু কেন সূর্যের কাছাকাছি এলে আইসন ভেঙে যেতে পারে বলে মনে করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?
তাঁরা জানান, অধিকাংশ ধূমকেতুর কেন্দ্রে থাকে ধুলোমিশ্রিত জমা বরফ। ওই বরফ তৈরি হয় জল, মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া জমে। ধূমকেতু কক্ষপথ পরিক্রমার সময় সূর্যের কাছে আসলে কিছুটা বরফ গলে যায়। কেন্দ্রের ধুলো এবং গ্যাস প্রচণ্ড বেগে ধূমকেতুর বাইরের ছুটতে থাকে। ফলে ঝাঁটার মতো লেজ সৃষ্টি হয়। তাতে সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হলে ঝাঁটা সমেত ধূমকেতু চোখে পড়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সূর্যের কাছে আসলেই প্রচণ্ড তাপে আইসনের ধুলো ও বরফ মিশ্রিত কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে পারে বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। |