নাৎসিরা ওগুলোকে বলত ফালতু জিনিস। তিনি কিন্তু ওগুলো আঁকড়েই বেঁচে আছেন। তাই ওগুলো দিয়ে দেওয়ার বা বিক্রি করার কথা বললে কপাল কুঁচকে যায় কর্নেলিউস গুরলিটের।
বয়স এখন ৮০। তাঁর মিউনিখের অ্যাপার্টমেন্টের একটি ঘরে ঠাসা অন্তত ১২৮০ অসামান্য শিল্পকীর্তি। মার্ক শাগাল, পাবলো পিকাসো, অরিঁ মাতিস, অটো ডিক্স, মাক্স লিবারমান কার ছবি নেই সেই তালিকায়। গোটা শিল্পসংগ্রহের আর্থিক মূল্য ছ’হাজার একশো কোটি টাকারও বেশি। গত মাসেই যে ছবি-ভাণ্ডারের কথা প্রকাশ্যে আসায় শুরু হয়েছে হইচই।
গুরলিটের বাবা হিল্ডারব্রান্ড ছিলেন নাৎসি জমানার শিল্প-ব্যবসায়ী। বাবার সংগ্রহ থেকেই ছবিগুলো পেয়েছেন গুরলিট। নাৎসিদের লুঠ করা বা কেনা এই ধরনের ছবি বিক্রির দায়িত্ব ছিল গুরলিটের বাবার। বাবার অবর্তমানে অমূল্য সব ছবি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন গুরলিট। যিনি বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি জার্মান পত্রিকায়। তার আগে শুল্ক অফিসাররা ওই অ্যাপার্টমেন্টে হানা দিয়ে সেই সব ছবি আটক করেছেন নানা জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়ে। আর তাতেই ভেঙে পড়েছেন একাকী গুরলিট। যিনি বছরখানেক আগেই ক্যানসারে আক্রান্ত বোন বেনিটাকে হারিয়েও এত কষ্ট পাননি। তাঁর কথায়, “ওরা আমার কাছ থেকে সব নিয়ে নিতে চাইছে। ছবিদের বিদায় দেওয়ার চেয়ে আমার কাছে বেদনার আর কিছুই নেই।” |
কর্নেলিউস গুরলিটের সংগ্রহে থাকা অরিঁ মাতিসের আঁকা ছবি। ছবি: এএফপি। |
এমনিতে কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না গুরলিট। গত সপ্তাহে চিকিৎসক দেখানোর জন্য জার্মানির অন্য শহরে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই কথা হয় শিল্প বিশেষজ্ঞ ভানেসা ভয়েটের সঙ্গে। তাঁকেই নিজের দুঃখের কথা জানান গুরলিট। টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছেন ১৯৬৩ সাল থেকে। ইন্টারনেট নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। কথা বলেন শুধু ছবিদের সঙ্গে। কাগজে আঁকা সব ছবি একটা স্যুটকেসে পরম যত্নে রেখে দিয়েছেন। প্রতি সন্ধ্যায় অসাধারণ ছবিগুলো দেখেন আর রোজ মুগ্ধ হন। তাদের সঙ্গেই শিশুর মতো খেলা। আর এই সম্পদ বাকি দুনিয়ার কাছ থেকে লুকিয়েও রেখেছিলেন। বাইরের লোকের জন্য খুব কম সময়েই গুরলিটের দরজা খুলত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ নেই। কোনও বন্ধুও নেই।
অর্ধ শতকেরও বেশি সময় কেটেছে পিকাসো বা শাগালের রংবেরঙের ছবির সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এত দিন গোপন থাকা গুরলিটের শিল্পভাণ্ডার হঠাৎ উন্মোচিত হওয়ায় পরে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বড্ড বিপদে পড়ে গিয়েছেন অন্তর্মুখী এই বৃদ্ধ। প্রচারের আলোয় এসে রীতিমতো বিরক্ত তিনি। বলছেন, “লোকে আমার কাছে কী চায়? আমি শান্ত, নির্বিরোধী লোক। শুধু ছবিদের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চাই।” জীবনে কাউকে ভালও বাসেননি? মুচকি হেসে গুরলিটের জবাব, “ওহ্! না। জীবনে আমার ছবিগুলোর চেয়ে বেশি আর
কিছুই ভালবাসিনি।”
ওই সংগ্রহ এত মূল্যবান বলেই হয়তো গুরলিট দিনে দিনে আরও গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তা ছাড়া, নিজের পরিবারের সঙ্গে কলঙ্কিত নাৎসি জমানার সংযোগটাও লুকিয়ে রাখতেই চাইতেন তিনি। কিন্তু তাঁর কি কোনও ভয় ছিল? বেআইনি ভাবে এত মূল্যবান ছবি নিজের কাছে রাখা কি ঠিক? গুরলিট তা মানেন না। শিল্পের মূল্য তিনি জানেন বলেই অসাধারণ সৃষ্টিকে নিজের গোপন প্রেমের মতো লালন করেছেন। তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্য এটাই যে মানুষ কাগজ আর রঙের টানের মধ্যেও শুধুই টাকাই খোঁজে।”
মিউনিখের প্রথম সারির শিল্প সংগ্রাহক কনরাড বার্নহাইমারের কানেও গিয়েছে গুরলিটের কথা। তিনি বলছেন, “মানুষটির জীবন কী দুঃখের। অসাধারণ সব ছবি নিয়ে নিজেকে আটকে রেখেছেন অন্ধকারে। ছায়ামানুষ, যাঁকে কখনওই সামনে দেখা যায় না।” নিজের পরিবারের শিল্প সংগ্রহ রক্ষা করাটাই যেন গুরলিটের জীবনের একমাত্র কাজ ছিল। তবে কালে কালে তাঁকেও আপস করতে হয়েছে। নিজের স্বাস্থ্যের অবনতির কারণেই। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে বেশ কিছু ছবি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
জার্মান শিল্পী মাক্স বেকমানের আঁকা ‘দ্য লায়ন টেমার’ তাঁর বিক্রি করা শেষ ছবি। যেটি নিলাম করে ৭ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন গুরলিট। তার ৪৫ শতাংশ আবার তিনি দিয়ে দেন সেই ইহুদি পরিবারকে যারা ছবিটির আদত মালিক। কোনও দিনই নিলামে দেখা যায় না যাঁকে, তাঁর কাছে হঠাৎ এমন দুমূর্ল্য ছবি? গুরলিটের সংগ্রহ নিয়ে জানতে অনেকেই আগ্রহী হন তখন থেকে। ভানেসা ভয়েটের মতে, গুরলিটের অ্যাপার্টমেন্ট কোনও সংগ্রাহকের নয়, কারণ সংগ্রাহক নিজের সংগ্রহ দেখিয়ে গর্ব বোধ করেন। বৃদ্ধ মানুষটি তো কেবল লুকিয়ে থাকতে চান। লুকিয়ে রাখতে চান আজন্ম লালিত ছবিদের। |