নতুন বেতন কমিশন বসিয়ে তার সুপারিশের ভিত্তিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের শর্ত, এ বাবদ যে বাড়তি আর্থিক বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে চাপবে, কেন্দ্রকেই তার দায় নিতে হবে। অর্থ মন্ত্রককে এই বার্তা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জানিয়ে দিয়েছে, দিল্লির তরফে এমন নিশ্চয়তা পেলে তবেই রাজ্য নতুন বেতন কমিশন গড়তে উদ্যোগী হবে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। কমিশন-প্রধানের নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে নতুন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই যে ২০১৬-র ১ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় কর্মীদের বেতন বাড়বে, বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা জানিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রক।
এমতাবস্থায় রাজ্যগুলো নিজেদের কর্মীদের বেতনবৃদ্ধির ব্যাপারে কী করবে, অক্টোবরের গোড়ায় তা জানতে চেয়ে সব রাজ্যকে চিঠি দিয়েছিল নর্থ ব্লক। কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গকেও। রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে লেখা সেই চিঠিতে অর্থ মন্ত্রকের ব্যয় বিভাগের যুগ্ম-সচিব (পার্সোনেল) সুধা কৃষ্ণন বলেছেন, ‘কেন্দ্র বেতন কমিশন গঠন করলে প্রতিটি রাজ্যও তাদের কর্মীদের জন্য পে কমিশন গড়ে। এটাই প্রথা। আপনি জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী করছে।’ পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন গঠন প্রসঙ্গেও রাজ্যের মতামত জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রক। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বশেষ, অর্থাৎ পঞ্চম পে কমিশন কার্যকর হয়েছে ২০০৬-এ। যদিও রাজ্য-কর্মীরা বর্ধিত বেতন হাতে পেতে শুরু করেছেন ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে। তিন বছরের পরিবর্তে বকেয়া (এরিয়ার) মিলেছে পনেরো মাসের।
নবান্ন থেকে কেন্দ্রীয় বার্তার উত্তর গিয়েছে গত সপ্তাহে। রাজ্যের অর্থ-সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী কেন্দ্রীয় অর্থ-সচিব আরএস গুজরালকে জবাবি চিঠিতে জানিয়েছেন, বর্ধিত বেতনের আর্থিক দায়ভার বহনে কেন্দ্র রাজি থাকলে তবেই রাজ্য নিজস্ব কমিশন গড়তে পারে। ‘রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য ওই কমিশন তৈরি হলে কেন্দ্রেরই উচিত বর্ধিত বেতনের খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করা।’ লিখেছেন দ্বিবেদী।
২০১১-র মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তুলেছিলেন, চৌত্রিশ বছরের বাম সরকার দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি দেনা নতুন সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে গিয়েছে। যার সুদ ও আসল মিলিয়ে ফি মাসে রাজ্যকে যে টাকা শুধতে হয়, তিন বছরের জন্য তা স্থগিত রাখতে (মোরাটোরিয়াম) কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন মমতা। পরবর্তী কালে রাজ্যের জন্য ‘স্পেশাল প্যাকেজ’-এরও দাবি পেশ করা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মীদের বাড়তি বেতনের সংস্থান করতে আগে কখনও কেন্দ্রীয় টাকা চাওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা। সেই হিসেবে ঘটনাটিকে তাঁরা নজিরবিহীন আখ্যা দিচ্ছেন।
এ হেন বেনজির দাবি কেন?
অর্থ দফতরের কর্তাদের ব্যাখ্যা: রাজ্যের কোষাগারে কার্যত হাঁড়ির হাল। রোজকার খরচ আর ঋণের কিস্তি শুধতেই প্রায় সব বেরিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের হিসেবে, চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব খাতে সাড়ে ৮৮ হাজার কোটি টাকা আসার কথা। অন্য দিকে বকেয়া ২ লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের সুদ-আসল বাবদই বছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা দিল্লি সরাসরি কেটে নিচ্ছে। ফলে হাতে যা পড়ে থাকছে, তা দিয়ে বেতন ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে উন্নয়ন অব্যাহত রাখাই কঠিন। এমতাবস্থায় নতুন কমিশন অন্তত ৩০% বেতনবৃদ্ধিরও সুপারিশ করলে বছরে আরও কম করে ২৫ হাজার কোটি প্রয়োজন। “তা মিলবে কোথা থেকে?” প্রশ্ন তুলছেন অর্থ-আধিকারিকেরা।
এবং এরই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রের কাছে অর্থের দাবি। অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “কেন্দ্র যখন রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা না-করে একতরফা নিজের বেতন কমিশন ঘোষণা করেছে, তখন দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র একা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ওদের উচিত ছিল রাজ্যগুলোর আর্থিক অবস্থা মাথায় রাখা।” একই যুক্তি দেখিয়ে আরও কয়েকটি রাজ্য মন্ত্রকে চিঠি পাঠিয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। কেন্দ্রের কী বক্তব্য?
রাজ্যের অভিযোগ দিল্লি মানতে চায়নি। “বেতন কমিশন ও মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) সম্পর্কে কেন্দ্র নির্দিষ্ট নীতি নিয়ে চলে। দশ বছর অন্তর বেতন-কাঠামো সংশোধন করা হয়। কেন্দ্রের শেষ (ষষ্ঠ) বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়েছে ২০০৬-র ১ জানুয়ারি। স্বভাবতই ২০১৬-এর ১ জানুয়ারিতে সপ্তম কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা শুরু হবে। সেই মতো দু’বছর আগে নয়া কমিশন গড়া হয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।” ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র। তাঁর এ-ও দাবি, “উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাদ দিলে এ যাবৎ কোনও রাজ্য কেন্দ্রের কাছে বর্ধিত বেতনের টাকা চায়নি।” যা শুনে অর্থ দফতরের শীর্ষ কর্তাটির পাল্টা যুক্তি, “আমাদের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। কেন্দ্র আগেই মেনে নিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ ঋণগ্রস্ত। অথচ ঋণ-মুক্তির কোনও প্যাকেজ দেয়নি।” আসন্ন চতুর্দশ অর্থ কমিশন তেমন প্যাকেজ দিলে কর্মীদের বেতন বাড়াতে সমস্যা হবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
কেন্দ্র-রাজ্য চাপান-উতোর চললেও রাজ্য-কর্মীদের একাংশ আশায় বুক বাঁধছেন। তাঁরা বলছেন, ২০১৬-র মে-র মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা। সে দিকে তাকিয়ে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই কিছু ভাববেন।
|
রাজ্যের ব্যয়-বোঝা |
বেতন |
পঞ্চম বেতন
কমিশনের আগে |
সুপারিশ
মানার পরে* |
বৃদ্ধির হার
(%) |
চলতি অর্থবর্ষে
(২০১৩-১৪) |
১৩৭৬৮.৬৪ |
২১৮৮০.৮২ |
৫৮.৯২ |
৩২৭৭২† |
পেনশন |
৪৪৩২.৭৯ |
৬৫১০.৫৭ |
৪৬.৮৭ |
১০৪৮০ |
সব অঙ্ক কোটি টাকায়
* ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে | † সঙ্গে বকেয়া ৩৮% ডিএ, অর্থাৎ আরও ১১৪০০ কোটি |
|