ঝাঁকড়া জামরুল গাছটায় ঠেস দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সোমারত্না, “খুব চেষ্টা করেছিলাম, জানেন। জানতাম মাঠ ভর্তি মাইন। একটায় পা পড়লেই...। যে কোনও সময়েই পড়তে পারে...আমি মরিয়া হয়ে চিৎকার উঠলাম, হাউই-ই হাউই-লে হুশ!”
তাঁর চিৎকার কানে পৌঁছনোর আগেই কেঁপে উঠেছিল মাটি। ধোঁয়া-ধুলোয় ঢেকে যাওয়া মাঠ, বারুদের কূট গন্ধ। আর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে তার তীব্র বৃংহন। ধোঁয়া থিতিয়ে এলে মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে সোমারত্না দেখেছিলেন ডান পায়ের অর্ধেকটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে, ধুলো-রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে রয়েছে বছর দেড়েকের শাবকটি।
জাফনার সেই মাইন ভরা মাঠ থেকে তার রক্তাক্ত দেহটা তুলে এনেছিল শ্রীলঙ্কার বন দফতর। মাস তিনেক গিয়েছিল পরিচর্যায়। তারপর এই ঢালু ঘাসের মাঠ, তাল, নিম, জামরুলের বাগান আর মা-ওয়ে নদীতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্নান সারতে যাওয়া, পিনাওয়ালারর এই অনাথ আশ্রমই তার ঠিকানা।
গত পাঁচ বছর ধরে এই খঞ্জ জীবনই মেনে নিয়েছে সামা। শুঁড় দিয়ে সোমারত্নার মাথায় বিলি কাটতে থাকে সামা। শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দেন মাহুত সোমারত্না। আদুরে গলায় বলেন, “যাব, এ বার স্নান করতে নিয়ে যাব!” দুপুরের ঠা ঠা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে সামা তার মাহুতের সঙ্গে হাঁটতে থাকে, হস্তিযূথের পিছনে, নিঃসঙ্গ, একা। |
ঠিক একা নয়। তার বন্ধু, ডান কান কাটা বিমুথিও চলল স্নানে। চোরা শিকারিদের ফাঁদ ছিঁড়ে পালাতে গিয়ে কানে গভীর ক্ষত হয়েছিল তার। সোমারত্না বলেন, “এমন বিষিয়ে গিয়েছিল যে অস্ত্রোপচার করে ওটা বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।” আরও আছে, ক্ষত বিষিয়ে ওঠায় শুঁড়ের বেশ কিছুটা একই ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে মঙ্গলার। রয়েছে লেজ-কাটা থেমিয়া। কিংবা জন্মান্ধ রাজা। তবে গত ক’বছরে আড়ে বহরে অনেকটাই বেড়ে উঠেছে ওরা। দ্বীপ রাষ্ট্রের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা রুহুনু, ইয়ালা জাতীয় উদ্যান কিংবা উইলপাত্তু, সিগরিয়া অভয়ারণ্যের দলছুট সেই সব হস্তি শাবকেরা এখন সাবালক।
অশক্ত, প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে পিনাওয়ালার অনাথ হস্তিকুলের মধ্যে রয়েছে নিছকই দলছুট হয়ে পরিবার-হারা হস্তি শাবকেরাও। তাদের অনেকেই এখন পূর্ণ বয়স্ক। সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে লড়াই-খুনসুটি-ভালবাসা নিয়ে দিব্যি সংসারও পেতেছে তাদের অনেকে। জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ফসল খেতে এসে ফিরে যাওয়ার সময়ে এক দিন দলছুট হয়ে পড়া মা-হারা সেই সব অনাথেরা ধীরে ধীরে ভুলেই গেছে তাদের বন্য জীবন।
এ দেশেও এমন অনাথ হস্তি-শাবকের সংখ্যা অজস্র। দলমা ফেরত দলছুট কিংবা চা বাগানের খানা-খন্দ, নালায় পড়ে যাওয়ায় দলে আর ফিরতে না পারায় পরিবার-হারা শাবকের সংখ্যা এ রাজ্যেও প্রতি বছর বাড়ছে। অনেক সময়ে বনকর্মীরা ওই সব শাবকদের উদ্ধারের পরে ফের দলে ফিরিয়ে দেওয়ার বিস্তর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে ব্যাপারে নিতান্তই দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সফল হননি বনকর্মীরা। দেশের ‘প্রোজেক্ট এলিফ্যান্ট’-এর অধিকর্তা এ এন প্রসাদের আক্ষেপ, “মানুষের সংস্পর্ষে আসায় দল থেকে এক বার ‘ত্যাজ্য’ হয়ে পড়লে আর কি ফেরা যায়!”
রাজ্যে ওই সব দলছুটদের ঠাঁই হয়, জলদাপাড়ার পিলখানার এক কোণায়। শ্রীলঙ্কায় সেই ঠিকানাই ‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’। কলম্বো থেকে সাকুল্যে ৮৩ কিলোমিটার। শ্রীলঙ্কার পুরনো রাজধানী ক্যান্ডি এবং হালের চোখ ঝলসানো কলম্বোর ঠিক মাঝামাঝি পিনাওয়ালা। পাহাড় কাটা পথে কাগিলা ছুঁয়ে মসৃণ রাস্তা পিনাওয়ালা গিয়েছে। ছোট্ট এই জনপদে চোখ ধাঁধানো কয়েকটি হোটেল-রেসর্ট সবই বছরভর সরগরম হাতিদের অনাথ আশ্রম দেখতে আসা বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে।
১৯৭৫ সালে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে অনাথ হস্তি শাবকদের জন্য ২৫ একর জায়গায় গড়ে ওঠে এই অনাথ আশ্রম। বছর তিনেক পরে শ্রীলঙ্কার জাতীয় পশুশালা দফতর এটির দায়িত্ব নেয়। তবে, ১৯৮২ সাল থেকে নিছকই অনাথ আশ্রমর তকমা ছেঁটে পিনাওয়ালার বাগানেই বন্দি হাতিদের প্রজনন শুরু হয়েছে। সেই থেকে গত ৩১ বছরে ২০টিরও বেশি শাবকের জন্ম হয়েছে এই বাগানে।
শ্রীলঙ্কার পশুশালার অধিকর্তা দুমিধা জয়রত্নে বলেন, “বাগানে আপাতত বিভিন্ন বয়সের ৮৮টি হাতি রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে জঙ্গলে মা-হারা হস্তিশাবকদের নিয়ে আশ্রম শুরু হলেও ক্রমে এখানকার হাতিদের মধ্যে প্রজননও শুরু হয়েছে। যতটা সম্ভব বন্য পরিবেশ বজায় রেখেই হস্তিকুলের দেখভাল করা হয়।” তবে, বাগানে বড় কোনও জলাশয় না থাকায় অদূরেই মা-ওয়ে নদীতে দিনে দু’বার হাতিদের স্নান করাতে নিয়ে যান মাহুতরা। তাদের পিছু পিছু নদী-পাড়ে হাজির হন তামাম পর্যটককুলও। তবে হ্যাঁ, ট্যাঁকের কড়ি গুনে। এমনকী অনাথ আশ্রমে তিন বছরের নীচে যে সব শাবক রয়েছে, টিকিট কেটে তাদের বোতলে দুধ খাওয়ানোর সুযোগও দেন আশ্রম কর্তৃপক্ষ।
১৯৭৫ সালে উইলপাত্তু অভয়ারণ্যে মা-মরা একটি শাবককে নিয়ে মহা ফাঁপড়ে পড়েছিলেন বনকর্তারা। দুমিধা বলেন, “ছটফটে সেই শাবকটিকে প্রথমে রাখা হয় বেনতোতা পর্যটন কেন্দ্রে। সেখান থেকে দেহিওয়ালা চিড়িয়াখানায়। তারপর ঠিকানা বদলে পিনাওয়ালায়। সেই সময় অনাথ আশ্রমটি পর্যটকদের কাছে বানিজ্যিক ভাবে খুলে দেওয়া হয়। যেমন ভাবা গিয়েছিল, প্রথম দিন থেকেই সেই অনাথ শাবকটিকে দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ে।”
কিন্তু হাতিদের নিয়ে এই ‘পর্যটন-বাণিজ্য’ না-পসন্দ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠনের। পিনাওয়ালা থেকে বেশ কয়েকটি হাতিকে বিভিন্ন মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রিও করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা এনভায়রন ট্রাস্টের পক্ষ থেকে তার বিরোধিতাও শুরু হয়েছে। পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন দুমিধা, “আমরা না দেখলে মা-হারা শাবকগুলিকে দেখবে কে বলুন!”
স্নান সেরে ফেরার পথে তার মাহুতকে খোঁজে সামা। তাকেই বা দেখবে কে? |