বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নয়, রাজনীতিতে স্বার্থই একমাত্র কালজয়ী। অতি পুরাতন কথাটি শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সত্য। বস্তুত, রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রয়োগেই স্বার্থের মহিমা সর্বাধিক প্রকট হয়। দৃষ্টান্ত: ভিয়েতনাম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। হো চি মিন সিটি এবং ওয়াশিংটন যদি অর্থনীতিতে অর্থনীতি মিলাইয়া দিব্য চলিতে পারে, তবে সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির শিল্পোদ্যোগ নয় কেন? সর্বোচ্চ আদালতে সিঙ্গুর মামলার পরবর্তী অঙ্কের জন্য আগামী এপ্রিল অবধি প্রতীক্ষা করিতে হইবে। তাহার পরেও মামলার নিষ্পত্তি কবে হইবে, তাহা আপাতত অজ্ঞাত। রাজ্য সরকারের জমি অধিগ্রহণ আইনের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত। কিন্তু আইন-আদালতের বৃত্তের বাহিরে যদি সিঙ্গুর সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়, সকলের লাভ। সর্বাধিক লাভ পশ্চিমবঙ্গ নামক অভাগা রাজ্যটির, নেতির রাজনীতি যাহার বৃহৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করিয়াছে। সিঙ্গুরের ইতিহাসও সেই নেতির ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পিছনে তাহার ভূমিকা ঐতিহাসিক। কিন্তু ইতিহাসকে আঁকড়াইয়া থাকা প্রকৃত নেতৃত্বের ধর্ম নহে। প্রকৃত নেতৃত্বের কাজ অগ্রবর্তী হওয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অগ্রবর্তী হউন। টাটা গোষ্ঠীর সহিত জমির লড়াই প্রত্যাহার করিয়া ওই জমিতেই তাহাকে শিল্পোদ্যোগে প্রবৃত্ত করিতে যত্নবান হউন। সিঙ্গুর দ্বিতীয় বার ইতিহাসের সূচনাবিন্দু হউক। নেতি নয়, ইতির ইতিহাস।
আদালতে টাটা গোষ্ঠী জানাইয়াছে, তাহারা সিঙ্গুরের জমি ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত নহে, ওই জমিতে তাহাদের মোটরগাড়ি প্রকল্পের ‘দ্বিতীয় পর্যায়’-এর পরিকল্পনা রহিয়াছে। রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা জবাব দিয়াছেন, তেমন কোনও পরিকল্পনার কথা তাঁহাদের জানা নাই। জবাবের মর্মার্থ: টাটা গোষ্ঠীর ‘পরিকল্পনা’ আসলে কথার কথা। আইনজীবীরা তাঁহাদের দস্তুর মতোই কথা বলিবেন। কিন্তু সরকার তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ মামলার গণ্ডিতে আপন চিন্তাকে বাঁধিয়া না রাখিয়া বৃহৎ ভাবনায় ভাবিত হওয়া। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা তাহার মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ও কাজে অধুনা বৃহৎ ভাবনার কিছু কিছু সুলক্ষণ স্পষ্ট। ক্ষুদ্র রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়া তাঁহারা রাজ্যের প্রকৃত উন্নয়নে কিছুটা মন দিয়াছেন। বিশেষত, শিল্পোন্নয়নে তাঁহাদের মনোযোগের সংকেত মিলিতেছে। এখনও তাহা সংকেতমাত্র। জমি নীতির সংস্কার এখনও দূর অস্ত্। সরকারি কোষাগার হইতে জনমনোরঞ্জনের উদ্যোগ এখনও প্রবল। কিন্তু কমলকুমার মজুমদারের জন্মশতবর্ষের পূর্বলগ্নে এই আশা নিতান্ত অসংগত হইবে না যে, আলো ক্রমে আসিতেছে। আদালতে টাটা গোষ্ঠীর বক্তব্যটিকে জমি না-ছাড়িবার জেদ হিসাবে না দেখিয়া মুখ্যমন্ত্রী তাহাদের পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-বিনিয়োগে আগ্রহের সংকেত হিসাবে গ্রহণ করিলে সিঙ্গুর নেতি হইতে ইতির প্রতীকে রূপান্তরিত হইতে পারে। তাহারা কত বিনিয়োগ করিতে চাহে, কোন প্রকল্পের জন্য কত জমি ব্যবহার করিতে চাহে, সে-সকলই খুঁটিনাটির প্রশ্ন, দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতেই তাহার মীমাংসা সম্ভব। কিন্তু সেই মীমাংসার উদ্যোগ যদি শুরু হয়, সিঙ্গুরে পাঁচ বছর আগে বিসর্জনের যে বাজনা বাজিয়াছিল, তাহা যদি নববোধনের বোলে রূপান্তরিত হয়, তবে গোটা দেশে তথা দুনিয়ায় একটি প্রবল সংকেত যাইবে। এই সংকেত যে, পশ্চিমবঙ্গে সত্যই পরিবর্তন আসিয়াছে। এই সংকেত যে, বর্তমান শাসকরা তাঁহাদের পুরাতন জেদ এবং ভ্রান্তি আঁকড়াইয়া বসিয়া নাই, ‘নবান্ন’ কেবল নূতন সচিবালয়ের নামমাত্র নহে। এই সংকেত এই রাজ্যের উন্নয়নী সম্ভাবনার পক্ষে অমূল্য বলিয়া প্রমাণিত হইতে পারে। সিঙ্গুরে যে রাজনীতির ফসল ফলিয়াছিল, তাহা ওষধির ন্যায় এক বার ফল দিবার পরে তাহার দিন ফুরাইয়াছে। এখন সিঙ্গুরও শিল্পোন্নয়ন চাহে। পশ্চিমবঙ্গ নূতন রাজনীতি চাহিতেছে। উন্নয়নের রাজনীতি। সিঙ্গুরে তাহার সূচনা হউক। |