|
|
|
|
সবুজ অর্থনীতির পথ খুঁজছে বিশ্ব
প্রেমাংশু চৌধুরী
কোপেনহাগেন থেকে ফিরে |
একা ভারতের মনমোহন সিংহ নন। ঘুম নেই গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদেরও। কারণ একটিই। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম।
জ্বালানির দাম বাড়লে মধ্যবিত্তের পকেটে টান পড়বে। জিনিসের দাম বাড়বে। ভোটে জনতার কোপের মুখে পড়তে হবে। দাম না বাড়ালে ভর্তুকির বহর বাড়বে। ঘাটতি লাগামছাড়া হবে। ধস নামবে অর্থনীতিতে। লোকসভা নির্বাচনের আগে এই উভয়-সঙ্কট নিয়ে মনমোহন সরকারের যেমন মাথাব্যথা রয়েছে, তেমনই এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলির রাষ্ট্রনেতারাও এ নিয়ে চিন্তিত। সম্প্রতি কোপেনহাগেনে ‘গ্লোবাল গ্রিন গ্রোথ ফোরাম’-এর মঞ্চে সেই কথাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন সবাই।
কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন অন্য চিন্তার কথাও শুনিয়েছেন। ভর্তুকির ফলে পেট্রোল-ডিজেল সস্তায় মিললে এগুলির ব্যবহার কমবে না। যত পেট্রোল, ডিজেল, কয়লা পুড়বে, ততই বাড়বে পরিবেশ দূষণ। তার বদলে সৌর-বিদ্যুৎ বা বায়ু-বিদ্যুতের মতো অপ্রচলিত শক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে সরব হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা যে ভাবে বাড়ছে, তার পরে এ কথা না ভেবে উপায় নেই। কিন্তু অপ্রচলিত শক্তির খরচ অনেক। সৌর-প্যানেল বসানো বা হাওয়া-কল তৈরির জন্য অর্থ আসবে কোথা থেকে? প্রশ্নটা তুলেছিলেন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জাঁ মার্ক আয়রল্ট। তাঁর বক্তব্য, পেট্রোল, ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয় রাজনৈতিক প্রয়োজনে। না হলে আমজনতার ভোট মিলবে না। ভর্তুকি দেওয়া, না দেওয়াটা তাই বরাবরই দেশীয় রাজনীতির তাগিদ। আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে তা ঠিক করে দেওয়া যায় না।
ভর্তুকি তোলার পক্ষে সওয়াল করলেও এই বিতর্ক যে থাকবে, তা মানছেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভাইস-প্রেসিডেন্ট র্যাচেল কাইট। তাঁর মতে, “গরিব মানুষের সমস্যার কথা বলে জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়ার যুক্তি দেখানো হয়। কিন্তু সেই ভর্তুকি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। ভর্তুকির টাকা জলেই যায়। তা দিয়ে কাজের কাজ হয় না।”
ভর্তুকির টাকা সরাসরি নগদে আমজনতার হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে মনমোহন সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ব্যুরো অব এনার্জি রিসোর্সের ডেপুটি সেক্রেটারি রবার্ট আইকর্ড বলেন, “ভর্তুকি ব্যবস্থার সংস্কারে ভারত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। তবে আরও কাজ বাকি। তেল-কয়লা আমদানি করে দেশ চালানোটা সাময়িক সমাধান হতে পারে।” আর একটা সমস্যাও আছে। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার রাষ্ট্রনেতারা বলেছেন, পরিবেশ দূষণের কথা ভেবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি না করলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাবে। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী হেলে থর্নিং-শ্মিট বলেছেন, পরিবেশ এবং আর্থিক বৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এই ‘সবুজ অর্থনীতি’ গড়ে তোলার পথ খুঁজতে হবে।
এশিয়ার দুই শক্তি, ভারত ও চিনও সেই পথ খুঁজছে। নয়াদিল্লিতে এখন জোর বিতর্ক চলছে, পরিবেশ আগে না আর্থিক বৃদ্ধি। যে সব বিনিয়োগ পরিবেশের ছাড়পত্রের অভাবে আটকে রয়েছে, সেগুলিকে দ্রুত ছাড়পত্র দিতে মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোপেনহাগেনের সম্মেলনে বেজিং জানিয়ে গেল, চিন ভবিষ্যতের রণকৌশল তৈরি করে ফেলেছে। চিনের বিদ্যুৎ মন্ত্রকের উপমন্ত্রী লিউ কুই বলেন, “আমাদের শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় পরিবেশের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ দূষণের ঠেলায় আমরা অস্থির।” চিনের অভূতপূর্ব আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গেই বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত চিনের গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশের উপরে। ১৯৮০ থেকে ২০১১-র মধ্যে জ্বালানি-বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে ৫৫০ শতাংশ। গোটা বিশ্বে চিনেই এখন পরিবেশের পক্ষে সব থেকে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়। অথচ চিনকেও তেল, কয়লা, গ্যাস আমদানি করেই দেশ চালাতে হয়।
হাল সামলাতে তাই চিনের কমিউনিস্ট সরকার লক্ষ্য নিয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২০ শতাংশ অপ্রচলিত উৎস থেকে তৈরি করতে হবে। চিনের জাতীয় অপ্রচলিত শক্তিকেন্দ্রের প্রধান ওয়াং জংয়িং বলেন, “যারা অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহার করছেন, তাঁরা কর ছাড় পাচ্ছেন। বায়ো-ডিজেল ব্যবহার করলেও কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। উল্টো দিকে শিল্পে কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারের উপর কর বসানো হচ্ছে।” সমস্যাটা হল, এর ফলে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তার দাওয়াই, এই কর থেকে আসা রাজস্ব অপ্রচলিত শক্তি তৈরিতে কাজে লাগানো। তাতেই গরিবদের সুরাহা দেওয়া। এ ভাবেই ধীরে ধীরে দূষণমুক্ত চিন গড়ে তোলার পথে এগোতে চায় বেজিং। জংয়িং জানিয়ে গেলেন, “আমাদের এই মডেলের নাম বিউটিফুল চায়না। সুন্দর চিন।” |
|
|
|
|
|