|
|
|
|
মাওবাদী তকমা থেকে রেহাই চান সুচিত্রার চিকিৎসা করা ভূদেব
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
আবার একটা নভেম্বর! দু’-দু’টো বছর পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না পশ্চিম মেদিনীপুরের বেনাশুলি গ্রামের ভূদেব মাহাতো।
যে মাওবাদী নেত্রীকে ‘টেটভ্যাক’ দেওয়ার জন্য ষাট পেরোনো ভূদেববাবুকে দু’মাস অন্তর আদালতে চক্কর কাটতে হচ্ছে, সেই সুচিত্রা মাহাতো আত্মসমর্পণের পরে পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু ভূদেববাবুর ‘মাওবাদী’ তকমা ঘোচেনি! বৃদ্ধের তাই প্রশ্ন, “সুচিত্রা মাহাতোকে যদি সরকার মাফ করতে পারে, তা হলে আমি কেন ছাড় পাব না?”
ভূদেব মাহাতো জামবনির গ্রামীণ চিকিৎসক, চলতি কথায় হাতুড়ে ডাক্তার। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর যৌথ
|
ভূদেব মাহাতো।
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ |
বাহিনীর সঙ্গে গুলিযুদ্ধে মারা যান মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজি। সেই সময় পুলিশের দাবি ছিল, কিষেণজির সহযোগী সুচিত্রা মাহাতো জখম অবস্থায় পালিয়েছেন। ভূদেববাবুর দাবি, জখম সুচিত্রার চিকিৎসা করার জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, যৌথ বাহিনীকে খুনের চেষ্টা, বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুত রাখার ধারায় মামলা হয়। যদিও পুলিশের বক্তব্য ছিল, কিষেণজির সঙ্গীদের মধ্যে যারা পালিয়েছিল, ভূদেব তাদেরই এক জন। কিষেণজির মৃত্যুর পাঁচ দিন পরে ২৯ নভেম্বর ভূদেববাবুকে ধরে পুলিশ। ভূদেববাবুর অবশ্য দাবি, চিকিৎসা করার সময় তিনি সুচিত্রাকে চিনতেন না। আর যেটুকু চিকিৎসা করেছিলেন, তা-ও হুমকির মুখে।
ধরা পড়ার পরে তিন মাস জেল খাটতে হয় ভূদেববাবুকে। তবে সিআইডি যথাসময়ে চার্জশিট দাখিল করতে না পারায় ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়ে যান তিনি। তারপর থেকে দু’মাস অন্তর ঝাড়গ্রাম আদালতে হাজিরার পালা চলছেই।
কিষেণজির মৃত্যুর পরে ঝাড়গ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন) অলোক রাজোরিয়া যে মূল এফআইআর করেছিলেন (কেস নম্বর: ৪৬/১১, তারিখ-২৫/১১/২০১১) তাতে কিন্তু সুচিত্রার নাম ছিল না। এ প্রসঙ্গে এডিজি (সিআইডি) শিবাজি ঘোষ বলেন, “একে কেন ধরা হল, ওকে কেন ছাড়া হল এই সব মেনে আদালত চলে না। আইনের অনেক নিয়ম রয়েছে।” এই নিয়মটাই বোধগম্য হচ্ছে না ভূদেববাবুর।
বেনাশুলি গ্রামের বাড়িতে বসে বৃদ্ধ বললেন, “চাষবাস আর ডাক্তারি করে মাসে মেরেকেটে হাজার তিনেক আয় হয়। তার মধ্যেই জোগাতে হয় উকিলের খরচ। দু’মাস অন্তর কোর্টে যেতে হয়। এক বার ঝাড়গ্রাম আদালতে যেতেই ৩০০টাকা বেরিয়ে যায়। আমরা গরিব মানুষ। এ ভাবে কত দিন চালানো সম্ভব?” ভূদেববাবুর আইনজীবী জয়ন্ত রায়ের অভিযোগ, “আমার মক্কেলকে পরিকল্পিত ভাবে মাওবাদী সাজিয়েছে পুলিশ।” ছত্রধর মাহাতো-সহ মাওবাদী সন্দেহে ধৃত একাধিক বিচারাধীন বন্দির হয়ে লড়েছেন ঝাড়গ্রাম আদালতের আইনজীবী কৌশিক সিংহ। কৌশিকবাবুর দাবি, “কিষেনজির মৃত্যু মামলায় পুলিশের দায়ের করা অভিযোগ প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে মেলে না। বহু ক্ষেত্রেই প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে নিরাপরাধদের অভিযুক্ত করেছে পুলিশ।” কৌশিকবাবুর দাবি অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছেন ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার তৎকালীন সুপার (বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার) প্রবীণ ত্রিপাঠি। তিনি বলেন, “কৌশিকবাবু ঠিক বলছেন না। এফআইআর করার সময় আমরা জানতাম না কিষেণজির সঙ্গে কারা ছিল। ফলে, সেখানে সুচিত্রার নাম দেওয়া যায়নি।”
দু’বছর আগে ২৪ নভেম্বর বিকেলের কথা স্পষ্ট মনে আছে ভূদেববাবুর। তিনি বলেন, “তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। হাত-মুখ ধুয়ে সবে চেম্বারে বসেছি। হঠাৎ চাদর মুড়ি দিয়ে দু’জন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পুরুষটি দরজা আগলে দাঁড়াল। আর মহিলা চাপা গলায় বলল, তার চোট লেগেছে। চিকিৎসা করতে হবে। দু’জনের কারও মুখ দেখা যাচ্ছিল না। ওই মহিলা পেটের দিকের চাদরটা তুলল। দেখলাম, ডান দিকে কাটা জায়গায় রক্ত ঝরছে।” ভূদেববাবুর কথায়, “আমি ততক্ষণে বুঝেছি, এরা মাওবাদী। বললাম, ‘এ আমার কম্ম নয়’। তখন ওরা হুমকি দিল। ভয় পেয়ে মহিলার হাতে একটা টেটভ্যাক দিলাম। বললাম, এর বেশি আমার কিছু করার নেই। ওরা তখন চলে গেল।” পরে রেডিওর খবরে জামবনির বুড়িশোল জঙ্গলে লড়াইয়ের খবর শোনেন ভূদেববাবু। জানতে পারেন কিষেনজির মৃত্যু ও সুচিত্রার জখম হয়ে পালানোর কথা।
২০১২ সালের ৯ মার্চ মহাকরণে আত্মসমর্পণের পরে সুচিত্রা মাহাতোকে পাশে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, গুলিবিদ্ধ সুচিত্রা পালিয়ে গিয়েছেন বললেও পুলিশ কিন্তু তাঁর আহত হওয়ার পক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। আহত সুচিত্রা তা হলে এত দিন কোথায় ছিলেন? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব ছিল, “আপনারা সব গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন সুচিত্রার কোমরে গুলি লেগেছিল। গ্রামে গ্রামের মতো চিকিৎসা হয়েছে। এখন প্রকৃত চিকিৎসা করাতে হবে।”
সে দিনের পরে সুচিত্রার জীবন পাল্টে গিয়েছে। তবে ভূদেববাবু এখনও মোকদ্দমার জালে আটকে। প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে রয়েছে ভূদেববাবুর। তাঁর কথায়, “দেখা করিয়ে দিন না একবার। সে দিন সন্ধ্যায় সুচিত্রাই আমার কাছে এসেছিল, নাকি সবটাই নাটক, এক বার জিজ্ঞেস করতাম।”
|
পুরনো খবর: সুচিত্রা নয়, ‘সাহায্যকারী’ যুবক ও হাতুড়ে ধৃত |
|
|
|
|
|