দেবতাদের নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। কার্তিক মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে জগদ্ধাত্রীর বিসর্জন। অতঃপর একাদশী থেকেই দেবতারা জেগে উঠেছেন।
দেবতাদের এই ঘুমিয়ে থাকা এবং জেগে ওঠাতেই বঙ্গীয় ঐতিহ্য। শরৎকালে দুর্গাপুজোর সময়েই উত্তর ভারতে নবরাত্রি উৎসব। ‘দশেরা’র ধুমধাম। কিন্তু ঘুমন্ত দেবীকে অকাল বোধন ঘটিয়ে জাগাতে হবে, একেবারেই বাঙালি রীতি। “বাল্মীকি বা তুলসীদাসে অকালবোধন পাবেন না। এটি কৃত্তিবাসী রামায়ণের নিজস্ব সংযোজন,” বলছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস। সম্প্রতি তিনি কলকাতায় এসেছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বক্তৃতা দিতে।
নির্মলকুমার বসুর তত্ত্বাবধানে কাজ করা র্যালফ আজও বাংলার ঐতিহ্যকে খোঁজেন অন্য দৃষ্টিতে। গবেষণার কারণে ষাটের দশকে তমলুকের গ্রামে প্রায় দুই বছর কাটিয়েছেন। অতঃপর সেই ফিল্ড নোটবুক থেকে এক সময় উৎসারিত হল গাজন, শীতলাপুজো, মনসাপুজো নিয়ে বই। দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোর শারদীয় উৎসব নিয়ে এই বছরেই বেরিয়েছে তাঁর ‘নাইট অব দ্য গড্স।’ বাংলার উৎসব এবং সামাজিক প্রথা নিয়ে এই প্রবীণ অধ্যাপক শিকাগোয় বসে নিঃশব্দে যে ভাবে কাজ করে চলেছেন, তা হুজুগে বাঙালিকে লজ্জা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তার জন্য অবশ্য লজ্জাবোধ থাকা দরকার।
কী ভাবে কাজ করছেন র্যালফ? ইউ টিউবে আজও দুর্গাপুজোর ভিডিও খুঁটিয়ে দেখেন। লক্ষ করেন, শহর আর গ্রামের পুজোয় তফাত অনেক। দুর্গাপুজো ছিল প্রধানত জমিদারদের পুজো। সামাজিক স্তরবিভাজন পরিষ্কার। কাছারির সামনে দুর্গাদালানে পুজো। কাছারিতেই জমিদার খাজনা নেবেন, প্রজাদের শাস্তিবিধান করবেন। ফলে, সেখানেই হবে পুজো। তিন দিন ধরে দুর্গার চোখে ধরা দেবে গ্রামসমাজের বিভিন্ন স্তর। পুরোহিত পুজো করবেন, কর্মকার বলি দেবেন, মালাকার মালা গাঁথবেন। শেষে সবাই প্রসাদ পাবে, এক সুতোয় বাঁধা থাকবে থাকবন্দি সমাজ।
কোম্পানির আমলে শহরেও শুরু হল পুজো। কিন্তু নব্যবাবুদের খাজনা আদায়, শাস্তিবিধানের অধিকার নেই। ফলে আলাদা ভাবে থাকা কাছারিবাড়ির দুর্গাদালান বিদায় নিতে শুরু করল। শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাদালান বাড়ির ভিতরেই। বদলে গেল দুর্গাপুজোর পরিসর।
নতুন রাজাদের পুজো শুধুই বিত্ত প্রদর্শন। সকলের প্রবেশাধিকার নেই, সাহেবসুবো ও বড় মানুষেরাই আমন্ত্রিত হন। বাইনাচ হয়, মদের ফোয়ারা ছোটে। শাস্ত্রীয় রিচুয়াল নয়, আমোদ-আহ্লাদই মুখ্য। “এই সময়েই বারোয়ারি পুজোর উদ্ভব। সেখানে সকলের সমান অধিকার। উনিশ শতকে বাংলার জনপরিসরে সমান অধিকারের ধারণার সূত্রপাত হয় ওই সব পুজোতেই”, বলছিলেন র্যালফ।
কিন্তু নামজাদা অনেক বারোয়ারি পুজো আজ রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষণা-ধন্য। সেখানে কি নেই থাকবন্দি ক্ষমতাকাহিনি? “ওটা চাঁদা, বিজ্ঞাপন বা বড় বাজেট জোগাড়ের ক্ষমতা। কিন্তু জনসংযোগই প্রধান। যে কারণে, লোক টানতে বছর বছর থিম বদলে যায়। বনেদি বাড়িতে এমন হয় না। পরিবর্তন নয়, ধ্রুপদী ঐতিহ্যই মন্ত্র।” |
র্যালফের তত্ত্ব, শারদীয় দুর্গাপুজো আবহমানকাল চলছে না। ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা গাজনকে আত্মসাৎ করার জন্য অকালবোধন চালু করেন। গুপ্তযুগেও বাংলায় কোনও ব্রাহ্মণ ছিলেন না। সংস্কৃত ধর্মসূত্রের মন্তব্য স্মরণীয়: গৌড়ের লোকেরা দস্যু, সেখানে দিন কাটালে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এ বার সেই কিংবদন্তি: রাজা আদিশূর কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণদের এই অজায়গায় নিয়ে এসে জমি দিয়ে বসত করান।
ব্রাহ্মণরা এসে দেখলেন, এ দেশে জনজীবনের মূল উৎসব চৈত্র মাসে: গাজন। জাতিভেদ নেই, সারা গ্রাম একসঙ্গে ধর্মঠাকুরের পুজোয় মেতে ওঠে। এই ধর্ম নিতান্ত লৌকিক দেবতা, যুধিষ্ঠিরের বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে থাকবন্দি শাসনকাঠামো ধরে রাখা যাবে না। অতএব শুরু হল উচ্চবর্গের বিচিত্র অন্তর্ঘাত। প্রথমেই এল দুর্গাপুজো। কিন্তু সেই বাসন্তীপুজো গাজনের জনপ্রিয়তা কমাতে পারল না। ক্ষমতা গাজনকে বরাবর সন্দেহ করেছে। আজও মন্দিরগাত্রের টেরাকোটায় চড়কপুজোর উপস্থাপনা খুঁজে পাওয়া যায় না।
চৈত্র হল বছরের দ্বাদশ মাস। তার উল্টো দিকেই ষষ্ঠ মাস: আশ্বিন। উত্তরাপথে নবরাত্রি সেই সময়। রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে বনে ঘুরছিলেন, মেধস মুনি সেই সময় তাঁকে শ্রীশ্রীচণ্ডী-র কাহিনি শোনান। রাজা দেবীর পুজো করে রাজ্য ফিরে পান। এ যে রাজধর্মের পুজো! সেই সংস্কৃত মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মুখ্যত তিন অংশ। প্রথম অংশে ৩২টি শ্লোক, দেবী মধু ও কৈটভ দানবকে বধ করেন। দ্বিতীয় অংশে ১০৯টি শ্লোক, দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। তৃতীয় অংশ আরও বড়, ১৯৩টি শ্লোক। “বাংলা দুর্গাপুজোর শাস্ত্রীয় আচার এই ন্যারেটিভ কাঠামো মেনে তৈরি। সপ্তমীর থেকে অষ্টমী পুজো আরও দীর্ঘ, নবমী পুজো আরও বেশি সময়ের,” বলছিলেন র্যালফ নিকোলাস।
এই সংস্কৃত চণ্ডীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল বাংলার চণ্ডীকে। মর্তে পুজো পাওয়ার জন্য কালকেতুকে রাজা করে দেন চণ্ডী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা মঙ্গলচণ্ডী কী ভাবে মিশে গেল, দুর্গাপ্রতিমাই তার প্রমাণ। বাঙালির কাছে দুর্গা একই সঙ্গে অসুরনাশিনী, শিবের ঘরনি, কৈলাস ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা কন্যা, কার্তিক, গণেশ এবং লক্ষ্মী, সরস্বতীর মা। গাঁজাড়ু স্বামীর ঘর করা সংস্কৃতে নেই। অসুরনাশিনী সেখানে লক্ষ্মীর মা এবং নারায়ণের শাশুড়িও নন। গাজনের জন-উৎসবকে উৎখাত করতেই ‘ক্ষমতা’ সংস্কৃত পুরাণ এবং বাংলা লোককাহিনি মিলিয়ে শারদীয় পুজোর আখ্যান তৈরি করে।
কিন্তু শরৎকালে পুজো হবে কী ভাবে? আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীতে দেবতাদের রাত শুরু। ঘুম ভাঙে কার্তিক মাসের একাদশীতে। “ব্রাহ্মণ্যবাদ তখন অকালবোধন শুরু করে। স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যর আগে অকালবোধনের কথা জানা যায় না। খেয়াল করবেন, লক্ষ্মী, কালী বা জগদ্ধাত্রী পুজোয় কিন্তু দেবীর ঘুম ভাঙানো হয় না,” জানাচ্ছেন র্যালফ।
দুর্গা ক্ষমতার পুজো, জগদ্ধাত্রীও তা-ই। বস্তুত দুর্গার তন্ত্রমন্ত্রে চার হাতের দেবীর যে বর্ণনা, তা জগদ্ধাত্রী রূপ। দশ হাতের দুর্গা মহিষাসুরনাশিনী, চার হাতের জগদ্ধাত্রী বধ করেন করিণ্ডাসুরকে। কালী বা চামুণ্ডাও অসুরকে ধ্বংস করেন। অসুরনাশই ক্ষমতার কাম্য। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো! সেখানে রাজমহিমা কোথায়? “লক্ষ্মীপুজোটা ইন্টারেস্টিং। গুজরাত, রাজস্থানে দীপাবলিতে হয় ধনলক্ষ্মীর পুজো। আর, গ্রামবাংলায় সে দিন মোচার খোলায় ষাঁড়ের নাদ, চুল ইত্যাদি রেখে অলক্ষ্মী বিদায় করা হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর কনসেপ্টটাই আলাদা। সেখানে মেয়েরা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন,” ফিল্ড স্টাডির কথা পাড়লেন র্যালফ।
আর সেখানেই তাঁর চমকপ্রদ তত্ত্বায়ন! মেয়েলি ব্রতকথা নয়, লক্ষ্মীর পাঁচালি রাজধর্মের কথাই বলে। রাজা ঠিক করেছেন, বাজারে কিছু বিক্রি না হলে তিনি নিজে সেটি কিনে নেবেন। এই ভাবেই এক বিক্রেতার থেকে অলক্ষ্মীর মূর্তি কেনেন তিনি। ফলে ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী সকলে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। বিরক্ত রাজা রানিকে জঙ্গলে রেখে আসেন। অসহায় রানি সেখানে ঘুরতে ঘুরতে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে গ্রামের মেয়েদের দেখে লক্ষ্মীপুজোয় বসেন। সেই পুজোর ফলে অলক্ষ্মী বিদায় নেয়। যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী সকলে প্রাসাদে ফেরেন। রাজাও রানিকে ফিরিয়ে আনেন। অতঃপর সুখে রাজ্যশাসন। “দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রীর থেকে ছোট আকারে হলেও লক্ষ্মী রাজধর্মেরই পুজো। গাজনকে উৎখাত করতে চারটি উৎসবই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের অবদান,” বললেন নৃতাত্ত্বিক।
জনগণের উৎসবে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ক্ষমতা এই ভাবেই নিজস্ব উৎসব তৈরি করে! এবং বোঝা যায়, বাঙালির উৎসব কোনও দিনই রাজনীতিবর্জিত ছিল না। |