উপরোধ-অনুরোধ করে, শর্ত চাপিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কোনও ভাবেই গ্রামে ডাক্তারদের পাঠানো যাচ্ছে না। নাকের বদলে নরুনের মতো তাই ডাক্তারের বদলে ‘কমিউনিটি হেল্থ অফিসার’-দের গ্রামে পাঠিয়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ফাঁক ঢাকার চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের তৈরি করতে চালু হতে চলেছে ‘বি এসসি (কমিউনিটি হেল্থ)’ নামে নতুন ‘স্নাতক’ পাঠ্যক্রম। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই পাঠ্যক্রম শুরু করতে চাইছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এ ব্যাপারে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।
কী থাকবে এই পাঠ্যক্রমে? স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, শিশু স্বাস্থ্য, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য পরিষেবা, সংক্রামক রোগ ইত্যাদি চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জ্ঞান সুনিশ্চিত করতেই পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে। এর জন্য মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়েছিল। তারা পাঠ্যক্রমের খসড়া তৈরি করার পর ‘ন্যাশনাল বোর্ড অব এগজামিনেশন’(এনবিই) তা খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত করেছে। পাঠ্যক্রম শুরু হলে বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র দেবে বলে ক্যাবিনেট নোটে লেখা হয়েছে।
নতুন স্নাতক পাঠ্যক্রমে কারা সুযোগ পাবেন, তা নিয়ে ক্যাবিনেট নোটে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, বিজ্ঞান শাখায় ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছেলেমেয়েদের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। তবে এমবিবিএস পাশ চিকিৎসকদের সমতুল মর্যাদা এরা কোনও দিনই পাবেন না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক যুগ্মসচিব জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত নতুন কোর্সটি শহরের কোনও মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হবে না। পড়ানো হবে গ্রামে। যাতে পড়াশুনা চলাকালীন সেই পরিবেশের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা মানিয়ে নিতে শেখেন। তা ছাড়া গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি সম্পর্কে যাতে তাঁরা হাতেকলমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেন। এ জন্য জেলায় জেলায় ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা স্কুল’ খোলা হবে। কোন জেলার কোথায় কত স্কুল হবে, তা ঠিক করবে রাজ্য। তার জন্য জায়গার ব্যবস্থা এবং শিক্ষক নিয়োগও করবে রাজ্য। পুরো বিষয়ের সিংহ ভাগ খরচ দেবে কেন্দ্র। ছাত্রছাত্রীদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হবে জেলার সদর হাসপাতালগুলিকে।
বস্তুত গ্রামে ডাক্তারদের অভাব মেটাতে অসম ও ছত্তীসগঢ় সরকার ইতিমধ্যেই এ ধরনের একটি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছে। সেই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই গত বছর সব রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবদের নিয়ে একটি বৈঠকে স্থির হয়েছিল যে অন্য রাজ্যগুলিও এমন কোর্স চালু করবে। কিন্তু পরে কোনও রাজ্যই আর এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হয়নি। তাই এ বার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকই নতুন পাঠ্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত অগস্ট মাসে এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলির মত চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ। রাজ্যগুলির মতামত নিয়ে পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয় সংশোধনও করা হয়েছে।
নতুন এই পাঠ্যক্রম নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর বা সেখানকার রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা। রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁদের স্পষ্ট করে কিছুই জানানো হয়নি। যদি এমন পাঠ্যক্রম শুরু হয়, তাতে রাজ্য কতটা সাহায্য করতে পারবে বলা যাচ্ছে না। কারণ হিসাবে তিনি ব্যাখ্যা দেন, “রাজ্যের নতুন মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শিক্ষক-চিকিৎসক দিতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আবার জেলায়-জেলায় স্কুল তৈরি করে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হলে রাজ্য শিক্ষক দেবে কোথা থেকে? জমি পাওয়া যাবে কোথা থেকে?”
তাঁর বক্তব্য, “ব্রিটেনের ‘রয়্যাল কলেজ অব জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স’-এর সঙ্গে চুক্তি সই করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এমবিবিএস ডাক্তারদের ‘কমিউনিটি মেডিসিন’-এর ডিগ্রি কোর্স শুরু করেছে। যার শর্ত , পাশ করে গ্রামে চিকিৎসা করতে যেতে হবে। তা হলে আর আলাদা করে ‘কমিউনিটি হেল্থ অফিসার লাগবে কেন?” রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “নতুন পাঠ্যক্রম অনুমোদন করেছিল মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার বোর্ড অফ গভর্নার্স’। সেটি এখন ভেঙে গিয়েছে। নতুন কাউন্সিল তৈরি হওয়ার মুখে। তারা নয়া পাঠ্যক্রম অনুমোদন না-ও করতে পারে।” যদিও আশাবাদী কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, ক্যাবিনেট নোট যখন তৈরি হয়েছে, সিদ্ধান্ত পাল্টাবে বলে মনে হয় না। |