কোনও কথার মূল্য অনেক সময়েই নির্ভর করে কে কোন পরিস্থিতিতে তাহা বলিতেছেন, তাহার উপর। তাই, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যখন বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটিলে দুর্নীতিও বাড়ে, কিংবা ভুল হইলেই তাহা অপরাধ হয় না, তখন বাক্যসমূহের অন্তর্নিহিত মূল্য গৌণ হইয়া যায়, মুখ্য হইয়া উঠে প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণের প্রেক্ষিতটি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহিত দুর্নীতির সম্পর্ক, কিংবা ভুলের সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক যদি এমন হইয়াও থাকে, দেশের প্রধান প্রশাসকের আসনে বসিয়া প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কখনওই তাহা বলা শোভন নহে। তাঁহার একমাত্র বক্তব্য হওয়া সম্ভব: দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, দুর্নীতি প্রমাণ হইলে যথাযোগ্য পদক্ষেপ লওয়া হইবে, দুর্নীতি কমাইতে প্রশাসন যথাসাধ্য স্বচ্ছতা রাখিয়া চলিবে। অথচ সি বি আই তদন্তে বেনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মনমোহন সিংহ যাহা বলিলেন, তাহা সংকেত দিল, শাসনবিভাগের দায়দায়িত্ব তাঁহার চিন্তায় আপাতত পিছনের সারিতে, সম্মুখে অন্য কোনও ভাবনা। সম্ভবত, নির্বাচনের আগে পিঠ বাঁচাইবার ভাবনা।
দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের পিঠ যে এখন বিশেষ বিপন্ন, সন্দেহ নাই। সুপ্রিম কোর্টের অভিযোগ, সি বি আই ‘খাঁচার তোতাপাখি’, সরকারি কর্তারা উহাকে বুলি শিখান। প্রধান বিরোধী দলের মত, সি বি আই সরকারের ‘নিজস্ব সেনাবাহিনী’, সরকারের যখন যাহাকে কব্জা করিবার দরকার হয়, সি বি আই লেলাইয়া দিলেই চলে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী যুগপৎ আসরে নামিয়াছেন, সি বি আই-এর উপর যে সরকারের ততখানি নিয়ন্ত্রণ নাই, তাহা প্রমাণ করিতে। প্রমাণ করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় হিসাবে আপাতত তাঁহারা সি বি আইকেই উল্টাইয়া বকাবকি করিতেছেন: কেন সি বি আই নিজেদের লক্ষ্মণরেখা পার হয়, কেন তাহারা তদন্তে সীমায়িত না থাকিয়া ‘পলিসি’-ক্ষেত্রে মতামত দেয় ইত্যাদি। ‘কোলগেট’ কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে সি বি আই তদন্তে প্রশ্ন উঠিয়াছে যে, ২০০৬ সালে কয়লাখনি নিলামের নীতি সত্ত্বেও পরবর্তী কালে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে কেন খনি-অধিকার প্রদান করা হইল। কিংবা, টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে, কেন ২০০৮ সালে দাঁড়াইয়া ২০০১ সালের দামে বিক্রয়পর্ব নিয়ন্ত্রিত হইল। অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম-এর প্রাঞ্জল বক্তব্য: কাজ হইয়াছে সরকারি সিদ্ধান্ত বা ‘নীতি’ অনুযায়ী, সি বি আই কিংবা অন্য কেহ এখানে প্রশ্ন তুলিবার কে! বাস্তবিক, এই ‘অন্য কেহ’-র প্রতি ইঙ্গিতটি চোখ এড়াইবার নহে। শাসনবিভাগের গুরুত্ব সজোরে প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া অর্থমন্ত্রী যে ভাবে সি বি আই-এর প্রতি ভর্ৎসনা বর্ষণ করিয়াছেন, তাহার দু’টি অর্থ সম্ভব। প্রথমত, সি বি আই-এর আড়ালে আসলে সুপ্রিম কোর্টকেই শাসন-বিষয়ে মাথা গলাইতে না বলা। দ্বিতীয়ত, সি বি আই ‘বাড়াবাড়ি করিতেছে’ বলিয়া সরকার গলা ফাটাইলে সরকারই যে সি বি আই-কে লইয়া পুতুলখেলার ‘বাড়াবাড়ি’টি করিয়া থাকে, সেই অভিযোগের ঝাঁঝ কমানো।
আবহমান কাল ধরিয়া সি বি আই-এর পিছনে অলক্ষ্য সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ। তবে গত কয়েক বৎসরে দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার যে ভাবে একের পর এক বৃহৎ দুর্নীতি-অভিযোগে ছিন্নভিন্ন, তাহা এক কথায় অ-ভূতপূর্ব। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন ‘ভুল’ হইয়াছে, ‘অপরাধ’ হয় নাই, তিনি ভুলিয়া যান যে, কোনটা ‘অপরাধ’ নহে, নিছক ‘ভুল’— তাহা প্রমাণ করিবার দায়িত্বও কিন্তু যে ভুল করিতেছে তাহার। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার মন্ত্রিসভা নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করুন, দায়িত্বে ভ্রান্তি ঘটিয়াছে মানিয়া লউন, আর না ঘটাইবার প্রতিশ্রুতি দিন: এ ছাড়া তাঁহাদের নিষ্ক্রমণের সহজতর রাস্তা নাই। |