গ্রহণযোগ্য অভিযোগে এফআইআর নিতেই হবে পুলিশকে
পরাধে যথোচিত গুরুত্ব না-দিয়ে স্রেফ জিডি লিখে ছেড়ে দেওয়ার দিন শেষ। ধর্তব্যযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় গেলে পুলিশকে এফআইআর নিতেই হবে বলে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। কোনও পুলিশ অফিসার এফআইআর নিতে না-চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছে পাঁচ বিচারপতির সংবিধান বেঞ্চ। তবে এফআইআরে নাম থাকা মানেই যে গ্রেফতারি নয়, শীর্ষ আদালত সেটাও স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে, অপরাধের প্রাথমিক প্রমাণ থাকলে তবেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা যাবে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, গ্রহণযোগ্য যে কোনও অভিযোগে (কগনিজিবল অফেন্স) পুলিশ এফআইআর লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য। তা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে থানার মর্জিতে গুরু অপরাধ লঘু হয়ে যাচ্ছে এমন নালিশ দীর্ঘ দিনের। দেশ জুড়ে বিভিন্ন ঘটনা ঘিরে তা বারবার মাথা চাড়া দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের রায়েও সেই বিতর্কের প্রতিফলন। শীর্ষ আদালতের আক্ষেপ, আইন যা-ই বলুক, বাস্তবে কোনও অভিযোগের এফআইআর হবে কি না, তা পুরোপুরি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট থানার ডিউটি অফিসারের সিদ্ধান্তের উপরে। তিনি চাইলে এফআইআর নেওয়া হয়। অন্যথায় জেনারেল ডায়েরি (জিডি) করে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা কোনও অভিযোগকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানোর পক্ষে যথেষ্ট।
কিন্তু এ সব আর চলবে না বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বেঞ্চের পরিষ্কার নির্দেশ: গ্রহণযোগ্য অপরাধের অভিযোগ থানায় এলে পুলিশকে আইনমাফিক এফআইআর লিখতেই হবে। যে অফিসার লিখবেন না, তাঁকে কড়া শাস্তি দিতে হবে। ‘ন্যায় বিচারের পথে প্রথম পদক্ষেপ হল এফআইআর। তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু হয়। এফআইআর ছাড়া তো তদন্তেরই অবকাশ থাকে না!’ মন্তব্য করেছেন বিচারপতিরা।
তাঁদের নির্দেশের অপব্যবহারও তো হতে পারে!
সেটা মাথায় রেখে সুপ্রিম কোর্ট কিছু ব্যতিক্রমেরও সংস্থান রেখেছে। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য: বিবাহ বা সম্পত্তিজনিত বিবাদ ও দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে এফআইআর দাখিলের আগে পুলিশকে প্রাথমিক তদন্ত চালিয়ে অভিযোগের যথার্থতা যাচাই করতে হবে। কারণ, এখানে মিথ্যে নালিশ করে হেনস্থার সুযোগ থাকে। তাই কোর্টের নির্দেশ: এ সব ক্ষেত্রে পুলিশকে সাত দিনের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত সারতে হবে। আর সেই তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে এফআইআর রুজু করে এগোতে হবে। “গ্রহণযোগ্য অন্যান্য অভিযোগে প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই পুলিশকে এফআইআর নিতে হবে। যে সব পুলিশ অফিসার নেবেন না, তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।” রায় দিতে গিয়ে বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবম।
বস্তুত মামলার তদন্ত ও বিচারে এফআইআরের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকারই সুযোগ এক শ্রেণির পুলিশ অফিসার নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এফআইআর কী ভাবে লেখা হচ্ছে, পুরো মামলার গতি-প্রকৃতি তার উপরে নির্ভর করে। যার সুবাদে বিভিন্ন গ্রেফতারির ঘটনায় পুলিশের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আচরণের কথা শোনা যায়। অনেক অভিযুক্তের আগাম জামিন নেওয়ার অবকাশও থাকে না। ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে যাদবপুরের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের যেমন ছিল না। এমতাবস্থায় এফআইআর-পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কেও পুলিশকে সজাগ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। নির্দেশে বলা হয়েছে, এফআইআর রুজু হওয়া মানেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা নয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনও প্রমাণ জোগাড় হলে একমাত্র তবেই তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে। নতুবা থাকতে হবে তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায়।
২০০৮-এ উত্তরপ্রদেশে এক অপহরণ-মামলায় এফআইআর করার বিনিময়ে পুলিশ ঘুষ চেয়েছে বলে মামলা দায়ের হয়। পরে তা সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। মামলাটি শেষে যায় সংবিধান বেঞ্চে, যেখানে এ দিন তার নিষ্পত্তি হল। পাঁচ সদস্যের সংবিধান বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। বাকিরা হলেন বিচারপতি বি এস চহ্বাণ, বিচারপতি রঞ্জন দেশাই, বিচারপতি রঞ্জন গগই এবং বিচারপতি এস এ ববডে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য অভিযোগে এফআইআর নেওয়াই তো পুলিশের কাজ! তা হলে নতুন নির্দেশ কেন?
আইন-নির্ধারিত কর্তব্যটি সম্পাদনে বহু ক্ষেত্রে যে পুলিশের তরফে গাফিলতি থেকে যায়, রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তা তা মেনে নিচ্ছেন। লালবাজারের এক অফিসারের কথায়, “অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনেক সময়ে পুলিশ চাপে পড়ে এফআইআর নেয় না।” তবে সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের নির্দেশে সেই চাপ অনেকটা কাটবে বলে ওঁরা আশাবাদী। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “এটি যাতে সর্বত্র কার্যকর হয়, তা নিশ্চিত করা আমাদের কাজ।” প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক, গ্রহণযোগ্য অভিযোগের এফআইআর করে তার প্রতিলিপি অভিযোগকারীকে দেওয়া পুলিশের দায়িত্ব। সুপ্রিম কোর্টের রায় ব্যবস্থাটিকে আরও পোক্ত করবে সন্দেহ নেই।”
অন্য রকম প্রতিক্রিয়াও মিলেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ শুনে রাজ্যের পুলিশমহলের একাংশ আবার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি। “এখন তো যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের অভিযোগ নিয়ে থানায় হাজির হলেই এফআইআর! এতে তুচ্ছ ঘটনা অহেতুক গুরুত্ব পেতে পারে।” বলছেন তাঁরা। এই মহলের দাবি, থানার অফিসারেরা এমনিতেই কাজের চাপে নাজেহাল। এ বার তাঁদের উপরে চাপ যেমন আরও বাড়বে, তেমন এফআইআরের জুজুতে মানুষকে অহেতুক হেনস্থার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। উপরন্তু কারও উপরে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেও এফআইআরের অপব্যবহার হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে পুলিশের সব মহল মোটামুটি একমত যে, এফআইআর ‘না-নেওয়ার’ জন্য রাজনৈতিক চাপ থেকে থাকলে নতুন নির্দেশের জোরে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। “তদন্তেও পুলিশ ঢিলে দিতে পারবে না। কিছু লোক কাউকে হেনস্থা করতে নির্দেশটির সাহায্য নিতে পারেন ঠিকই। কিন্তু আখেরে সাধারণ মানুষেরই সুবিধা হবে।” মন্তব্য এক পুলিশকর্তার।
আমজনতা কতটা সুফল পেল, আগামী দিনই বলবে।

নালিশ-নামা
এফআইআর কী?
ফার্স্ট ইনফর্মেশন রিপোর্ট। অভিযোগকারীর বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশের তৈরি প্রাথমিক লিখিত রিপোর্ট, যা অপরাধের বিচারের পথে প্রথম পদক্ষেপ।

কে করতে পারেন?
আক্রান্ত ব্যক্তি বা তাঁর হয়ে অন্য কেউ, কিংবা অপরাধের কোনও প্রত্যক্ষদর্শী। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও পুলিশকর্মীও পারেন।

কী ভাবে?
লিখিত ভাবে তো বটেই, মৌখিক ভাবে, এমনকী ফোনেও অভিযোগ দায়ের করা যায়।

থানা এফআইআর না-নিলে?
উচ্চতর অফিসারদের সরাসরি বা ডাকে চিঠি পাঠিয়ে নালিশ জানানো যায়। কাজ না-হলে কোর্ট, মানবাধিকার কমিশন।

মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করলে?
পুলিশকে ভুল পথে চালনার অভিযোগে মামলা হতে পারে।
(সূত্র: ভারতীয় পেনাল কোড, ১৯৬০, ধারা ২০৩)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.