বাড়ির চারপাশে একফালি জমি। চালে রয়েছে চালকুমড়ো। মাচা বেয়ে উঠছে পালং। বাড়ির সামনের জমিতে ধনেপাতা, কুমড়ো, মূলো আর ঘরের অন্ধকার কানাচে মাশরুমের ব্যাগ। বাড়ির চারপাশের সামান্য জমিতে এত কিছু ফলতে পারে, তা দেখে অভিভূত মেগান মাইলান। মার্কিন এই চিত্র পরিচালক দিনহাটার ভূতকুড়া গ্রামে এক কিশোরীর বাড়িতে ক’দিন শ্যুটিং করে গেলেন। ২০০৯-এ উত্তরপ্রদেশের কিশোরী পিঙ্কি সোনকরকে নিয়ে তাঁর ছবি ‘স্মাইল পিঙ্কি’ তথ্যচিত্র বিভাগে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) জিতেছিল। এ বার তাঁর ছবির নায়িকা কোচবিহারের কিশোরী মনিকা বর্মন।
মার্কিন এক সংবাদপত্রে খবর ছিল, কোচবিহারের প্রায় ৪০ হাজার মেয়ে টুকরো জমিতে নিজের হাতে ফলাচ্ছে নানা সব্জি। কিছু নিজেরাই খাচ্ছে ভাতের পাতে, কিছু বিক্রি করছে বাজারে। তাতেই এই তথ্যচিত্র করার চিন্তাটা মাথায় আসে মেগানের। সানড্যান্স ইন্সটিটিউট এবং গেটস ফাউন্ডেশনের অনুদান নিয়ে তিনি চলে এসেছেন দিনহাটার ভূতকুড়ায়। স্কুলছুট মনিকা যে দিন তার বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে নিজের ফলানো কুমড়ো বিক্রি করল, আর বাবা তার ভাগের ২০ টাকা তুলে দিলেন মেয়ের হাতে, সেই প্রথম রোজগারের বাস্তব মুহূর্তটি নিজের ক্যামেরায় তুলে নিয়েছেন মেগান। |
মনিকাকেই বাছা হল কেন?
কারণ, ওই সব্জি চাষ যেটুকু বাড়তি রোজগার আনবে, আত্মপ্রত্যয় বাড়াবে, তা হয়তো মনিকার বিয়ে ঠেলে দিতে পারে আঠারোর ওদিকে। মনিকার মতো বহু মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় চোদ্দো-পনেরো-ষোলোয়। তাঁদের জন্যই শুরু হয়েছে ‘সবলা প্রকল্প’। কোচবিহারের দিনহাটা ১ আর তুফানগঞ্জের দু’টি ব্লকে কয়েক হাজার মেয়ে ওই প্রকল্পে জানছে, এক টুকরো জমি তাদের পায়ের তলায় জমি দিতে পারে। দক্ষিণ মরাডাঙার অনিমা পাল ফলিয়েছে ঝিনুক মাশরুম। অষ্টমী পালের মাচার নধর লাউ দেখে ‘ইস ইস’ করছে বন্ধুরা। আর ঝিনাইডাঙার শ্যামলী রায়ের প্ল্যাস্টিক ব্যাগ থেকে বেরিয়ে বাটন মাশরুম ফুলের মতো থোকা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট কোচবিহারের তিনটি ব্লকের ৩৮টি অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে ‘সবলা’ রূপায়ণে সহায়তা করছে। ওই কেন্দ্রগুলির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ হাজার ১১-১৮ বছর বয়সী মেয়ে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মেয়েদের মর্যাদা, এমন নানা বিষয়ের সঙ্গে মেয়েদের জমির অধিকার নিয়েও কথা বলছেন প্রশিক্ষকেরা। সরকারের দেওয়া জমি বেচা যায় না, জমি পেলে বা কিনলে কোথায় রেজিস্ট্রি করতে হয়, তা জেনে গিয়েছে দিনহাটা তুফানগঞ্জের কিশোরীরা। দক্ষিণ মরাডাঙার রিয়া পাল বাড়ি গিয়ে জমির দলিলও দেখে নিয়েছে। “ঠাকুরদার নামে জমি ছিল। এখন ঠাকুমার নামে। তারপর ..,” বলল রিয়া।
তারপর? এ বার বাবার জমি মার নামেও লেখা হবে কি? ভাইদের সঙ্গে সমান জমি কি পাবে রিয়া, শম্পা, বুলবুলিরা? ওদের মুখে দ্বিধা, গলায় জড়তা। মেয়েদের বিয়েতে যে বড্ড খরচ। আর বাবা, মাকে ভাই-ই তো দেখবে। তাই ওরা কেউ বলল, ‘মেয়েদের একটু কম জমিই পাওয়া উচিত’। আবার কারও গলায় জেদ, ‘না একই রকম দিতে হবে’। কিন্তু জমি থাকলে পণ আসবে কী করে? পণ না দিলে কে বিয়ে করবে? |
এমন দোলাচলে থাকা কিশোরীদের প্রতিনিধি হিসেবেই মনিকাকে বেছে নিয়েছেন মেগান। বহু গবেষণার পরে। তবে মনিকা ব্যতিক্রমী নয়। আঠেরোর আগে বিয়ে হওয়া দিদির সাজগোজ দেখে তারও অমন গয়না পরতে ইচ্ছে করে। আবার নিজের হাতে তৈরি জমিটুকুকে ঘিরে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্নও সে দেখে। তার বাবাও কখনও ‘মেয়ের ভাল’ চেয়ে তাকে পার করতে চান আবার কখনও সব্জির বাজারে নিয়ে গিয়ে সহকর্মীর মর্যাদাও দেন। মেগান বললেন “এই টানাপোড়েনকে ধরতে চাই আমি। কোন দিকে যাবে আমার জীবন, তা নিয়ে ভাবে সব কিশোরীই। ফ্রান্স বা ব্রাজিলের একটি মেয়েও মনিকার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবে।”
জানুয়ারির শেষে আমেরিকার সানড্যান্স ফেস্টিভ্যালে মনিকা বর্মনকে নিয়ে মেগানের ছবিটি দেখানো হবে। এপ্রিলে দেখানো হবে লন্ডনে। চলচ্চিত্র উৎসবের বাইরেও মিনিট দশেকের এই ছবিটি নানা আলোচনায় দেখাতে আগ্রহী গেটস ফাউন্ডেশন। মেগান বলছেন, “স্মাইল পিঙ্কি ছবি করার পরে চেরা ঠোঁটের সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছিলেন। এই ছবিটা দেখে যদি মেয়েদের জমির অধিকার নিয়ে একটু কথাবার্তা হয়, মন্দ কী?”
|