চিকিৎসকের ১৩৫ পদ শূন্য, রুগ্ণ গ্রামীণ স্বাস্থ্য
খুব বেশি দিন হয়নি বীরভূমের গ্রামীণ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার হাল সরেজমিনে খতিয়ে দেখে গিয়েছে ‘ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশনে’র (এনআরএইচএম) কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। তাঁদের সেই রিপোর্ট এখনও আসেনি। কিন্তু ফল যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের খুব একটা খুশি করবে না, তা ধরেই নিয়েছেন জেলা স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের অনেকেই। কারণ, রোগী থেকে চিকিৎসা-ব্যবস্থায় যুক্তদের একটা বড় অংশেরই অভিযোগ, বীরভূমের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অধিকাংশই এখন চিকিৎসকের অভাবে কার্যত ধুঁকছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি তো চলছে একমাত্র ফার্মাসিস্ট এবং নার্সদের ভরসায়। জেলার তিনটি মহকুমার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা পৃথক ‘স্বাস্থ্য জেলা’ হিসেবে ঘোষিত রামপুরহাটের অবস্থা যে সব থেকে খারাপ, তা একবাক্যে সবাই মেনে নিচ্ছেন। খোদ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডল বলছেন, “সিউড়ি সদর হাসপাতাল, রামপুরহাট, বোলপুর এই দুই মহকুমা হাসপাতাল-সহ বীরভূমের ১৫টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৪টি গ্রামীণ হাসপাতাল এবং ৫৮টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সব মিলিয়ে ১৩৫ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য হয়ে পড়ে আছে।” এ দিকে, জেলায় যে ২৪ জন চিকিৎসক ‘ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন’-এ নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইতিমধ্যেই চার জন কাজ ছেড়েছেন। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দাবি, “শূন্যপদে চিকিৎসক নিয়োগের জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন জানিয়েছি। প্রতি মাসেই রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে রিপোর্টও পাঠিয়েছি। এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।”
জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ মানব উন্নয়ন রিপোর্ট বলছে, রাজ্যে প্রতি এক লক্ষ নাগরিকের জন্য ৪৬ জন চিকিৎসক থাকলেও এই জেলায় সেই সংখ্যা মাত্র ৮। অথচ পাশের বর্ধমানেও সেই সংখ্যা বীরভূমের প্রায় দ্বিগুন। এখন জেলার সব থেকে জনঘনত্বপূর্ণ মহকুমা হল রামপুরহাট। মহকুমার ৮টি ব্লকের দু’টি গ্রামীণ হাসপাতাল, ছ’টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ২৩টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য খাতায় কলমে রয়েছে ৬২৭টি বেড এবং ৮১ জন চিকিৎসক। অথচ ১,১৭৩টি শয্যা এবং ১০৩ জন চিকিৎসক রয়েছে জেলার সব থেকে কম জনঘনত্বপূর্ণ মহকমা সিউড়িতেই। তার উপর জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, মহকুমার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৮১ জন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ৫২ জন কাজ করছেন। বাকিগুলিতে চিকিৎসকের পদ খালিই পড়ে আছে। জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, “এই সব কারণে, পুরো স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার উপরে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি চাপ পড়ছে। যার জেরে গ্রামীণ অংশের স্বাস্থ্য পরিষেবার মান অত্যন্ত অসম।”
রামপুরহাট মহকুমায় মুরারই ১ ব্লকে রাজগ্রাম ও চাতরায় দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসকের অভাবে দু’টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই চলছে ফার্মাসিস্টদের ভরসায়। রাজগ্রাম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোবিন্দলাল বিশ্বাস বলছেন, “এখানকার পাথর শিল্পাঞ্চলে হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। এ ছাড়া লাগোয়া ঝাড়খণ্ড সীমান্ত এলাকা থেকে কালাজ্বর, ম্যালেরিয়ার রোগী আসেন। আবার রাজগ্রাম-সহ মুর্শিদাবাদের বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার জন্য রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরই নির্ভরশীল।” কিন্তু এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও সেখানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র এক জন। গৌরাঙ্গবাবুদের খেদ, “ভাবতেও খারাপ লাগছে চিকিৎসকের অভাবে ফার্মাসিস্টদের ভরসায় দিনের পর দিন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা চলছে।” নলহাটি ২ ব্লকের শীতলগ্রাম এবং ভদ্রপুরেও দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কেন্দ্র আছে। শীতলগ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকের অভাবে ফার্মাসিস্টের ভরসাতেই চলছে। ভদ্রপুরে আবার চিকিসকও নেই, ফার্মাসিস্টও নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাচ্ছেন তিন জন নার্স। পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই নলহাটি ১ ব্লকের কয়থা এবং কুরুমগ্রামে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র দু’টিতেও। একই হাল রামপুরহাট ১ ব্লকের উদয়পুর, বৈধরা ও কাষ্ঠগড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। অন্য দিকে, ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক নেই। একই চিত্র মহম্মদবাজার ব্লকের পুরাতন গ্রাম, লাভপুর ব্লকের দাঁড়কা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র দু’টিরও।
চিকিৎসক না থাকা এমনই এক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক ফার্মাসিস্টের অভিজ্ঞতা, “দুর্ঘটনায় জখম, সাপে কাটা, বিষ খাওয়া, প্রসূতি কত রকমের রোগী আমাদের এখানে আসেন। কাউকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দিতে হয়, কাউকে ভর্তি করে নিতে হয়। কিন্তু চিকিৎসকই তো নেই। এই পরিস্থিতিতে যতটুকু জানি, সেই বিদ্যা দিয়েই রোগীদের চিকিৎসা করি।” আবার ফার্মাসিস্টই দাবি করছেন, ওই পরিস্থিতিতে রোগীর চাহিদা মতো ওষুধ থেকে স্যালাইন না দিলে তাঁর আত্মীয়েরা পিঠ আস্ত রাখবেন না! এই নিয়ে ক্ষুব্ধ একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, “কত দিন এ ভাবে চলতে পারে বলুন তো? চিকিৎসক না থাকার কথা জানাতে গেলে প্রায়ই রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের তোপের মুখে পড়ে ঝামেলা পোহাতে হয়।” উল্টো দিকে জেলার প্রত্যন্ত সব অঞ্চল থেকে পরিষেবা নিতে আসা রোগীরা, তাঁরাই বা কী করবেন? রাজগ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীর আত্মীয় মকবুল শেখ বলছেন, “আমরা কী তাহলে চিকিৎসকের অভাবে মারা যাব? সরকার কিছু একটা ব্যবস্থা তো করুক।” ভদ্রপুরের বাসিন্দা তুষার কর্মকার আবার ক্ষোভ, “এই ভাবে বারবার যদি আমাদের রামপুরহাট বা সিউড়ি হাসপাতালে ছুটতে হয়, তাহলে ঘরের পাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো সরকার তুলে দিলেই তো পারে!” বস্তুত, রামপুরহাট মহকুমার গ্রামীণ স্বাস্থ্যের এমন বেহাল অবস্থা কোনও ব্যতিক্রমই ঘটনা নয়। জেলার অন্য মহকুমাগুলির গ্রামীণ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার চেহারাও কমবেশি এক। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং গ্রামীণ হাসপাতালগুলি প্রায় সর্বত্রই প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাবে কার্যত ধুঁকছে। গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসকের অভাব নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, রাজ্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ২,৮০০ জন চিকিৎসকের অভাব ছিল। সেখানে বর্তমানে ১,৮০০ জন চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। তাঁর দাবি, “বেহাল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা আগের থেকে অনেক ভাল। কিছু দিনের মধ্যেই ‘হেলথ্ সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে’র মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে। তাতে আশা করা যায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও উন্নত হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.