রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ এড়াতে এ বার দার্জিলিং সফরে আসা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে আনকোরা একটি দাবি তুললেন গোর্খা জনমুক্তি নেতা বিমল গুরুঙ্গ। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপিতে জিটিএ (গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-কে কেন্দ্রীয় উত্তর-পূর্ব বিষয়ক মন্ত্রকের আওতায় নিয়ে আসার আর্জি জানিয়েছেন গুরুঙ্গ। রাজভবন সূত্রে খবর, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার জন্য মোর্চা নেতাকে পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। জিটিএ-র চিফ এগ্জিকিউটিভের দায়িত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যও রাষ্ট্রপতি গুরুঙ্গকে অনুরোধ করেছেন।
এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই দার্জিলিং নিয়ে ত্রিপক্ষ বৈঠক বসতে পারে। তার আগে রাষ্ট্রপতির প্রথম দার্জিলিং সফরেই আজ তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করলেন মোর্চা-প্রধান গুরুঙ্গ। গ্রেফতার মোর্চা নেতাদের দ্রুত মুক্তির দাবি-সহ পাঁচ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপিও প্রণববাবুর কাছে পেশ করে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন মোর্চা-প্রধান। তবে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি এই স্মারকলিপিতে অনুচ্চারিতই ছিল। |
গ্যাংটকে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। রবিবার। ছবি: পি টি আই |
মাত্র দু’সপ্তাহ আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মোর্চা নেতারা। মুখ্যমন্ত্রীকে ওই বৈঠকেই মোর্চা নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন বনধ্ প্রত্যাহার করা হবে। তার পরে দার্জিলিং এখন একেবারেই স্বাভাবিক। লেবং হেলিপ্যাডে নামার আগেই উঁকি দিয়েছে তুষারমোড়া কাঞ্চনজঙ্গা। ঝকঝকে রোদে আজ যেন সত্যিই হেসেছে শৈলশহর। দোকানপাট খোলা। হেলিপ্যাড থেকে রাজভবন পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে উৎসাহী মানুষের ভিড়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে জঙ্গিপুরের সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। দিল্লি থেকে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে সঙ্গে নিয়ে আজ দার্জিলিং এসে পৌঁছন রাষ্ট্রপতি। পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে বিমানেই দু’জনের দীর্ঘ আলোচনা হয়। আগেই সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন গুরুঙ্গ। রাষ্ট্রপতি সচিবালয় সূত্রের খবর, রাজভবনে মধ্যাহ্নভোজের আগে গুরুঙ্গের সঙ্গে একান্তে প্রায় ১৫ মিনিট কথা হয় রাষ্ট্রপতির।
কিন্তু কী আলোচনা হল উভয়ের? রাজভবন সূত্রে বলা হয়েছে পাঁচটি বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন গুরুঙ্গ। এক, গ্রেফতার হওয়া মোর্চা নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি। তাঁর অভিযোগ, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার আশ্বাস দিলেও ঢিলেমি করছে। দুই, কেন্দ্রীয় উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন মন্ত্রকের আওতায় জিটিএ-কে সামিল করা। তিন, পাহাড়ে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়া। চার, বনাঞ্চলের জমিকে জিটিএ-এর আওতায় আনা এবং পাঁচ, তফসিলি জাতিভুক্ত গোর্খাদের বাদ দিয়ে বাকি সকলকে তফসিলি উপজাতিভুক্ত করা। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এই সব দাবি-দাওয়া নিয়ে গুরুঙ্গকে কোনও আশ্বাসই দেননি প্রণববাবু। শুধু বলেছেন, তিনি কেন্দ্রের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
তবে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আগে পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে গুরুঙ্গ কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের যে দাবি করেছেন তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ক’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মোর্চা নেতারা বলেছিলেন, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের তুলনায় রাজ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেই তাঁদের ভরসা বেশি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে আবার কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ কেন দাবি করছেন তাঁরা? কেনই বা কেন্দ্রের উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন মন্ত্রকের আওতায় জিটিএ-কে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানানো হচ্ছে?
অনেকে এটাকে মোর্চার নরম-গরম রাজনীতির অংশ বলে মনে করছেন। রাজ্য সরকারকে চাপে রাখতেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করলেন গুরুঙ্গ। আবার এ-ও হতে পারে, নতুন দাবি তুলে নিজের প্রাসঙ্গিকতাই ধরে রাখার চেষ্টা করছেন মোর্চা-প্রধান। মোর্চার একটি অংশ ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের দাবি ঠিক হলে লেপচাদের একটা বড় অংশও এখন মোর্চার সঙ্গে নেই। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির চাপে পড়েই ফের কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চাইছেন গুরুঙ্গ।
গুরুঙ্গের সঙ্গে প্রণববাবুর বৈঠক নিয়ে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা অনেকেই সন্দিহান। তাঁদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন পর কোনও রাষ্ট্রপতি দার্জিলিঙে এসেছেন, এটা খুবই ভাল কথা। কিন্তু গুরুঙ্গের সঙ্গে কেন একান্তে বৈঠক করবেন তিনি? প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাংবিধানিক এক্তিয়ার তো তাঁর নেই! জবাবে রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের কর্তাদের বক্তব্য, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা পাহাড়ের একটি রাজনৈতিক শক্তি। তারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি সময় দেবেন না কেন? গণতন্ত্রে আলোচনাই তো সমস্ত সমস্যা সমাধানের পথ।
দার্জিলিঙে আজ মাত্র আড়াই ঘণ্টা ছিলেন রাষ্ট্রপতি। বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে বৈঠকের পর সেন্ট জোসেফ স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর বক্তৃতায় পরোক্ষে রাজ্যের অখণ্ডতার পক্ষেই সওয়াল করেছেন রাষ্ট্রপতি।
|
সহ-প্রতিবেদন: রেজা প্রধান |