আরব সাগরের তীরে ওয়াংখেড়ের সমুদ্রগর্জন, মহানায়কের ক্রিকেট-পৃথিবী থেকে অন্তিম বিদায়ের আবেগঘন প্রেক্ষাপট, বাইশ গজের এক টুকরো বৃত্তে চার্চগেট থেকে বান্দ্রার হুড়মুড়িয়ে উঠে আসা ধরে নেওয়া যাক আগামী বৃহস্পতিবার সব একই থাকল। ধরে নেওয়া যাক, বিশ্বের সর্বত্র থেকে সাংবাদিকের ঝাঁক তিলধারণের জায়গা রাখল না ওয়াংখেড়ে প্রেসবক্সে। ভিভিআইপি এনক্লোজারও ঠিক একই রকম ঠাসা।
শুধু ধরা যাক, সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের বদলে ড্রেসিংরুম থেকে ১৪ নভেম্বরের সকালে বেরিয়ে এলেন কোনও এক ব্রায়ান চার্লস লারা!
সচিন নন, ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস হাতে মাঠে ঢুকছেন ক্যারিবিয়ান প্রিন্স। কিন্তু অবস্থানটা তাঁর সচিনের মতোই। দু’শো টেস্ট খেলছেন, পড়ে আর পাঁচ দিনের ক্রিকেট, তার পর অবসর...।
আগের রাতে মনে কী চলবে?
মুখের পরিভাষায় একটু বিভ্রান্তি বুঝি। সঞ্চালকের প্রশ্নে একটু সময় নিয়ে উত্তর এল, “আমি সচিনের জায়গায় থাকলে ভাবতাম, আমার তো আর কাউকে কিছু প্রমাণ করার নেই। ভাবতাম আমাকে একটা বড় স্কোর করতে হবে, তার জন্য আমাকে প্রস্তুত হতে হবে।”
বক্তার নাম? ব্রায়ান চার্লস লারা। |
রবিবারের লারা |
|
|
সকালে সিমলা স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে। |
দুপুরে ইডেনে। —নিজস্ব চিত্র। |
|
যাঁর চেহারায় আজ অতীতের চেয়ে একটু ভারিক্কি ভাব বেশি। যিনি এখন চুয়াল্লিশ, চোখে চশমাও উঠেছে। বয়স ভুলে যাঁকে আজও বন্ধুবান্ধবরা বলে ফেলে, “আর নামতে পারো না?” যিনি ওয়াংখেড়ে যাচ্ছেন পুরনো বন্ধুর ক্রিকেটের অন্তিম ইনিংস দেখতে। এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘টক শো’-এ বসে এক সময় বলে ফেললেন, “সচিন, তোমার কিন্তু ক্ষমতা আছে ওয়াংখেড়েতে চারশো করার!”
অবাক লাগছে? লাগতে পারে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে তাঁর বিদায়ী টেস্টে নিজ-রেকর্ডের সিংহাসন অর্ধেক ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে, পাঁচ মিনিট পিছু এক বার করে সচিন নিয়ে বিনয়-প্রদর্শন, এত নরম-সরম কবে ছিলেন লারা? ‘টক শো’-র অন্য ‘প্রিন্স’, মানে ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ যখন বলে ফেলছেন, “সচিনের ঘুম হবে কি না জানি না। কিন্তু নার্ভাস হবেই হবে। আমি তো দেখেছি, ও অত রিল্যাক্সড থাকতে পারে না,” লারা তখন বলে চলেছেন, “সচিন, তুমি অতশত ভাববে কেন? তোমার মতো দুর্ধর্ষ ক্রিকেট কেরিয়ার তো আর কারও নেই। ওই পাঁচ দিন তুমি শুধু আনন্দ করবে...।”
আসলে এই লারা অতীতের মতো বদমেজাজি আর নন। এই লারা স্বচ্ছন্দে সিএবি কর্তাদের প্রস্তাবে এক কথায় মাদার হাউজে যাবেন, গিয়ে গোলাপের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন। এই লারা সিমলা স্ট্রিটে স্বামীজির বাড়ি গিয়ে অনায়াসে বলে ফেলবেন, “ত্রিনিদাদে থাকার সময়ই ওঁর কথা শুনেছি। উনি যুবসমাজের অনুপ্রেরণা। সব ধর্মের উর্ধ্বে স্বামীজি।” এই লারা স্বামীজির বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপে গিয়ে আলোকচিত্রীদের ধমক দেবেন। চেঁচিয়ে বলবেন, “আরে উনি তো দেবী। আপনারা কিনা দেবীর দিকে পিছন ফিরে ছবি তুলছেন! আমার পাশে এসে ছবি তুলুন না!” কালো কালিতে রামকৃষ্ণ মিশনের স্মারকপত্রে লিখে আসবেন, ‘এখানে এসে গর্ব হচ্ছে। স্বামীজির প্রাণশক্তি সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হোক।’ এই লারা ইডেনে ঢুকে সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র সঙ্গে রসিকতা করবেন, “আচ্ছা, এখানে একটা ভেটারেন্স ম্যাচ করুন না আপনারা। সচিন দু’শো করবে। দাদা একশো থেকে দেড়শোর মধ্যে। আমি একশো পঁচিশ।” এই লারা কোনও ভাবেই নিজের সর্বকালের সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানের লিস্টে নিজেকে ঢোকাবেন না। সচিন, ভিভ, বর্ডার, গাঙ্গুলি, পন্টিংসেখানে সবাই থাকবে। শুধু লারা বাদে। স্বয়ং গাঙ্গুলি পাশে বসে বার দু’য়েক ‘লারা...লারা’ করলেও নয়। |
দুই রাজপুত্র
বহু দিন পরে এক ফ্রেমে ব্রায়ান লারা এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
সিএবি-র এক অনুষ্ঠানে রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
সকালে আরসিজিসি-তে গল্ফ দিয়ে শুরু। সন্ধেয় সিএবি আয়োজিত দুর্ধর্ষ টক শো দিয়ে শেষ। রবিবার লারার ‘ক্যাজুয়াল লিভে’ কত যে রং ধরল দিনভর! সৌরভের ব্যাটিং নিয়ে বলতে গিয়ে সঞ্চালক প্রণয় রায় একবার বলে ফেললেন যে, ‘আপনার ব্যাটিং নিয়ে বলা হত, ব্যাটিং তো নয় যেন জলের উপর দিয়ে হাঁটছেন। এত সুন্দর।’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সৌরভ বলে উঠলেন, “আর লারার ব্যাটিং দেখলে মনে হয় যেন আকাশ দিয়ে হাঁটছে! এতটাই মসৃণ।” সৌরভ এক ফাঁকে বলে বসলেন, লারার সঙ্গে তিনি প্রথম থেকেই বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। এত মহান ক্রিকেটার বলে! এত মহান মানুষও নাকি সৌরভ খুব কম দেখেছেন। লারার আবার পাল্টা সার্টিফিকেটসৌরভের মতো দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন আর পায়নি ভারতীয় ক্রিকেট। আর সচিনের অবসর? সৌরভের মনে হয়, তাঁর প্রিয় ‘ছোটবাবু’-র জায়গায় তিনি থাকলে, এক বছর আগেই অবসরটা নিয়ে ফেলতেন। লারার মনে হয়, যতই লম্ফঝম্ফ শুরু হোক, সচিনের ধারেকাছে পৌঁছনোর ক্ষমতা বোধহয় ভবিষ্যতের কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরই হবে না।
বক্সিংয়ে যেমন মহম্মদ আলি। বাস্কেটবলে যেমন মাইকেল জর্ডন। ক্রিকেট বলতেও লারা শুধু একটা নামই বোঝেন, বুঝবেন।
সচিন তেন্ডুলকর! |