রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩
একটা[ভয়]কষ্টলজ্জাঘেন্না
ষ্ণতা ভারী আমেজ দেয়। এক রকমের স্বস্তি বা, বলা যেতে পারে, আরাম। যেমন মিঠে রোদ বা পশমের সোয়েটার, গরম চা বা ঘেঁষাঘেষি আড্ডা। কিন্তু এমন এক উষ্ণতা আমি সঞ্চয় করে রেখেছি, যেটা আমাকে থেকে থেকেই দেয় সাংঘাতিক অস্বস্তি, অসম্ভব ছটফটানি আর একটা ভয়ংকর কুঁচকে যাওয়া। আর বললে বিশ্বাস হবে না, এখনও পায়ের তলায় আমি সে উষ্ণতা অনুভব করি। ঝেড়েঝুড়ে ধুয়েমুছে রেহাই পেতে চাই। খুন করার কুড়ি বছর পরেও মাঝরাতে খুনি যেমন উঠে হাত ধোয়, ঠিক তেমন।
হাড়িকাঠের পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে ছিটকে যাওয়া রক্তে পা পড়ে গিয়েছিল আমার। গুলিয়ে ওঠা নাড়িভুঁড়ি, হাড় কেঁপে যাওয়া অস্তিত্ব নিয়ে কোনও মতে পাশ কাটিয়েই যাচ্ছিলাম তো। হঠাৎ পা পড়ে গেল। একটু আগে চেঁচাচ্ছিল প্রাণপণ। ছোট্ট ছাগলটা। হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে। আর সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বিশেষ কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ।
সে-ও যাবে না ওই হাড়িকাঠে। আর আমাদের বাড়ির লোকজনও ছাড়বে না তাকে। বলি দেবেন যিনি, রেডি হয়ে গেছেন খাঁড়া নিয়ে। ছাগলটার গলার দড়িটাকে শক্ত করে পাকড়ে টেনে টেনে নিয়ে আসছে এক জন। সে ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা... ডাকছে। আর চণ্ডীমণ্ডপ মুখরিত ‘মাআআআআ, মাআআআআআ’ শব্দে। পুরোহিত মশাই হাতে নিয়ে এলেন কিছু বেলপাতা, ঠুসে দিলেন ছাগলটার মুখে। সে মুখ হাঁ করে গোঙাতে লাগল। হাড়িকাঠে সেট করা হল তার গলা। বাড়ির ছেলেদের ডাক পড়ল। যে যার মতো মনের জোর কাচিয়ে নিয়ে নিজেদের জুতে দিল মহান কর্তব্যে। এত ক্ষণ ঝালর দেওয়া ঢাক বাজছিল লাগাতার। হঠাৎ চুপ। এ বার তো সেই সময়, যখন মায়ের নামে উৎসর্গ করা হবে একটি জলজ্যান্ত প্রাণী। আর সেই হত্যায়, সেই মার্ডারে, নাকি সব্বার মঙ্গল হবে! ‘মাআআআআ, মাআআআআআ’ ডাক অবিরত চলেছে। আমার পেট গুড়গুড় করছে, বমি পাচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। মায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছি দুই বোন। মা কাঁপছে, বুঝতে পারছি। সবাই টেনশন করছে এক চোটে জবাই হবে তো? না হলে অমঙ্গল। আর হাড়িকাঠ দুলছে। প্রাণীটার কানটা ঝটপট ঝটপট নড়ছে। আমি মা’র কোলে মুখ চেপে কাঁদছি আর বলছি, ওকে ছেড়ে দিতে বলো না মা, প্লিজ। দিদি ভয়ে সাদা হয়ে গেছে।
আর বাবা? আমার আর দিদির বাবা? সে তো খারাপ লোক নয়, সে তো সব্বাইকে ভালবাসে, ভালবাসতে শেখায়। তা হলে সে কী করে গিয়ে পাঁঠার পা চেপে ধরল। ও মা, বাবাকে বলো না ওকে ছেড়ে দিতে। মা খালি কান্না চেপে বলছে, ‘ওটা নিয়ম।’ আমাদের বাড়ির নিয়ম, বাড়ির ছেলেরা ছাড়া কেউ পাঁঠা ধরতে পারবে না। আমি জানি, আমার বাবা পারে না। আমার বাবা পারতে পারে না। কিন্তু পারতে তো হচ্ছে তাকে। একটা সময় কানফাটা শব্দে ‘জয় মা জয় মা’ বলল সবাই। আর বলির খাঁড়া উঠল আর নামল। আর কী জোরে, কী জোরে যে ঢাক বেজে উঠল, কী বলব। সবাই বলল, যাক, মা রক্ষা করেছেন। সেই প্রাণীর ধড়-মুণ্ড আলাদা। চোখ দুটো উল্টো হয়ে গেছে। মুখে ঠোসা রয়েছে সেই বেলপাতাগুলো। গলা দিয়ে তখনও রক্ত ছিটকে ছিটকে পড়ছে। আমি ছুটলাম। অত জোরে আমি স্পোর্টসের ১০০ মিটারেও ছুটিনি। আর তখনই, গরম রক্ত আমার পায়ের তলায় লেগে গেল। আর ছাড়ল না। কখনও ছাড়ল না। এক বছর মা আর রক্ষা করলেন না। বলিদানে দু’চোট হল। পুজো ভেস্তে গেল। বাড়ির পাশেই গঙ্গা। সেখানে ফেলে দেওয়া হল পুজোর সব উপচার। আর সঙ্গে ফেলে দেওয়া হল আরও একটা রীতি বলিদান। আমার বাবা সেই জলাঞ্জলির রীতিতে খুব সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি ভাসিয়ে দিতে পারলাম কই? অন্ধকার ঘরে আমি তো একা থাকতে পারি না। ঢাকের আওয়াজ শুনলে মনে হয়, সেই বাজনাটা বাজাবে না তো? মা, মা করে ডাকটার মধ্যে এত আতঙ্ক লুকিয়ে থাকতে পারে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.