|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
অল্প বয়সে বেতারে যাঁদের গান শুনতাম, তাঁদের কেউ কেউ চলে গিয়েছেন আগেই, কেউ কেউ বিদায় নিচ্ছেন এখন, ক্রমে ক্রমে। আমার এক রসিক চিকিৎসক-বন্ধু আমায় বলেছিলেন আমাদের কপালে বোধ হয় এক্সপায়ারি ডেট লেখা থাকে। কার মেয়াদ কখন যে ফুরোবে কেউ জানে না।
মানুষের আয়ু আর শিল্পীজীবনের আয়ুর মধ্যে মিল থাকে না অনেক সময়, বিশেষ করে লঘুসংগীতে। মার্গসংগীতে, দেখা যায়, সত্তর বছর বয়সেও কোনও কোনও কণ্ঠশিল্পী দিব্যি ধ্রুপদ বা খেয়াল গাইছেন। তাঁদের কণ্ঠ শুনে অবশ্যই বোঝা যায় যৌবনে ও মাঝবয়সে যে আওয়াজ তাঁদের ছিল, তা আর নেই। নিতান্ত শারীরবৃত্তের কারণেই তা থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু শিল্পীর ‘কণ্ঠমাধুর্য’ বা কণ্ঠের সুঠাম, জোরালো আওয়াজের জন্য (যে জন্য দম লাগে, বয়স বেড়ে গেলে যা কমে যায়) কেউ সচরাচর ধ্রুপদ খেয়াল শুনতে যায় না, শোনে না। ওই আঙ্গিকে শিল্পী কোন রাগের অন্তর্লীন সম্ভাবনাগুলি ভাবনার ক্রমোন্মোচনের পথ ধরে আমাদের সামনে মেলে ধরছেন, সেটাই থাকে শিল্পীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা। ধরা যাক, আঙ্গিকটি হল খেয়াল। খেয়ালশিল্পীর কাছে রসিক শ্রোতা যান শিল্পী কোন মেজাজে, কোন রাগের রং আমাদের মনে মাখিয়ে দিতে চান তা শুনতে ও জানতে। সত্যি বলতে, লঘুসংগীতের বেলা আমরা যেমন শিল্পীর কণ্ঠমাধুর্য বা কণ্ঠসৌষ্ঠবের ওপর জোর দিই, ধ্রুপদ ও খেয়ালশিল্পীদের বেলা তা দিই না। শুধু তাই নয়। রাগসংগীত ও তার আঙ্গিকগুলি এমনই যে, শিল্পীর বয়স বেশি হলে তবেই প্রাপ্তির মাত্রা ও পরিমাণ বাড়তে পারে বলে অভ্যস্ত শ্রোতারা মনে করেন। নবীন শিল্পীর গান-বাজনা অভ্যস্ত শ্রোতারা শুনতে যান যাচাই করে নিতে, সেই শিল্পী কেমন তালিম পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, কতটা খাটছেন এবং কতটা তাঁর প্রতিশ্রুতি। প্রবীণ শিল্পীর কাছে রসিক শ্রোতা যান সমৃদ্ধ হতে। সমৃদ্ধ হতে বয়স্ক, পক্বকেশ বা বিরলকেশ, বলিরেখাভরা মুখের, কিছুটা ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত কণ্ঠের এই শিল্পীর জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনা ও কল্পনার গভীরতায় ও বিস্তারে। শিল্পীর গলা আর হয়তো আগের মতো স্বচ্ছন্দ নয় মন্দ্র অথবা তারসপ্তকে। তানের ক্ষিপ্রতা হয়তো গিয়েছে কমে। যৌবনে ও মধ্যবয়সে কণ্ঠ যতটা স্ববশ থাকত, আজ আর হয়তো তা থাকে না। কিন্তু তাও আমরা প্রবীণ শিল্পীর শরণার্থী। আরও সংগত হয় যদি বলি প্রবীণ শিল্পীরই শরণার্থী। তার কারণ তাঁর ভাবনা, মেজাজ।
‘জানি না বয়স হলে কেন প্রেমে এত পাক ধরে
জানি না হৃদয় কেন রাত জেগে পায়চারি করে।’
কোন নিশির ডাক শুনে রাত জেগে পায়চারি করে বেড়ায় হৃদয়। সেই হৃদয়ের গান শুনতে রসিক শ্রোতা যান প্রবীণের কাছে। বয়স বেশ খানিকটা বেড়ে গেলে তবেই বোধ হয় মানুষ রবীন্দ্রনাথের ‘এ মোহ-আবরণ খুলে দাও’-এর মর্ম বুঝতে পারে। কথায় কথায় তানবাজি আর কণ্ঠকসরত, সুযোগ পেলেই তিনসপ্তক জুড়ে দখলদারির নিশান ওড়ানোর ‘মোহ-আবরণ’ খুলে শিল্পী তখন দাঁড়ান (আবার আমার নাছোড়বান্দা রবীন্দ্রনাথ) ‘আজি কোন্ সুরে বাঁধিব দিন-অবসান-বেলারে’-র আলোছায়ায় আলোর চেয়ে ছায়া-ই যেখানে বেশি। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
তাঁর বয়স যখন চারের কোঠায়, আচার্য আমীর খান একটি হিন্দি ছায়াছবিতে ‘আড়ানা’ রাগটি যে ভাবে গেয়েছিলেন, তিন তালে রীতিমত দ্রুত লয়ে যে অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় বোলতান ও তান করেছিলেন প্রায় কুলকুচো করার মতো সহজে, সেই ভাবে তিনি আড়ানা আর গাননি তার বছর পনেরো পরেই। ইন্টারনেটে পড়ছিলাম: তাঁর এক ঘনিষ্ঠ শিষ্য তাঁকে বেশি বয়সে জিজ্ঞেস করেছিলেন কুড়ি বছর আগে আপনি কী মারাত্মক সব তান-ই না করতেন। আজকাল আর করেন না তো? উত্তরে আচার্য আমীর খান নাকি বলেছিলেন আগে আমি জানোয়ার ছিলাম, এখন মানুষ হতে চেষ্টা করছি। এমন কথা বলতে এক জন প্রবীণ আমীর খানকে দরকার হয়। বেশি বয়সের আমীর খান-ই আসল আমীর খান।
লঘুসংগীত বিষয়টা কিন্তু অন্য। মার্গসংগীতে বয়স অন্তত চল্লিশ পেরনোর আগে কোনও শিল্পীকে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। লঘুসংগীতে তার উলটোটাই মোটামুটি রীতি। আধুনিক গানের শিল্পীরা তাঁদের যৌবনেই চিহ্নিত হয়ে যান। এই গানের যে দক্ষ শিল্পীদের আমরা আজও মনে রেখেছি, তাঁরা যৌবন ও মধ্যবয়সের মধ্যেই পারদর্শিতা ও খ্যাতির শিখরে উঠে গিয়েছিলেন। কোনও কোনও গায়ক যৌবনে একটি মাত্র গ্রামোফোন রেকর্ড করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যেমন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র দীপক মৈত্র। পঞ্চাশের দশকে অল্প বয়সেই যখন বাংলার গানের আকাশ ঝলমল করছিল বিভিন্ন কণ্ঠশিল্পীর প্রভায়, তিনি গ্রামোফোন রেকর্ড করেন: ৭৮ আর পি এম। এক পিঠে ‘এ তো নয় শুধু গান’ আর অন্য পিঠে ‘কত কথা হল বলা’। আপশোস, ভারী মিষ্টি গলা ও সাবলীল গায়কির অধিকারী এই শিল্পী অকালে মারা যান।
প্রথম যৌবনে দীপক মৈত্র যে মানের গান রেকর্ড করেছিলেন, পাঁচের কোঠা পেরিয়ে সেই মানে তিনি আর পৌঁছতে পারতেন কি না সন্দেহ। প্রথমত, গলার ওই মাধুর্যই তাঁর আর থাকত না বেশি বয়সে। আধুনিক বাংলা গানের দুনিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির কথা ভেবে দেখলে বোঝা যায়, গত শতকের তিরিশ থেকে অন্তত সত্তরের দশক পর্যন্ত গানগুলি তৈরি হয়ে এসেছে কয়েকটি দিক মাথায় রেখে:
১) শিল্পীর কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর; মাইক্রোফোনে বেশ ভাল শোনায়।
২) গায়কিতে শিল্পী দক্ষ; গানের সুরতালছন্দের প্রতি তিনি অনায়াসে সুবিচার করতে পারবেন।
৩) তাঁর উচ্চারণ যথাসম্ভব মার্জিত এবং শিক্ষিত নাগরিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য।
মোটের ওপর এই তিনটি শর্ত সামনেই থাকত। এর মধ্যে তৃতীয় শর্তটি শুধু যৌবনে নয়, প্রৌঢ়ত্বেও পূরণ করা সম্ভব, যদি না দাঁতের সমস্যা থাকে। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত দু’টি বেশির ভাগ শিল্পীকে মুশকিলে ফেলতে পারে তাঁদের বেশি বয়সে। যৌবনে ও মাঝবয়সেও কণ্ঠশিল্পীদের গলায় যে তাজা ভাব, সাবলীল গতি, তিনসপ্তক জুড়ে গাইতে পারার ক্ষমতা (যার সঙ্গে সাবলীল শ্বাসপ্রশ্বাস ও দমের যোগ নিবিড়) থাকে, যে ভাবে তাঁরা স্বর প্রক্ষেপ করতে পারেন, ছয়ের কোঠা তো বটেই, এমন কী পাঁচের কোঠা পেরোলেই কণ্ঠের ওই গুণগুলি আর থাকে না বিশেষ করে পুরুষ শিল্পীদের ক্ষেত্রে। তা সত্ত্বেও বাংলার একাধিক নামজাদা কণ্ঠশিল্পী বেশি বয়সেও তাঁদের যৌবন-মাঝবয়সের গানগুলি গেয়েছেন। অনুষ্ঠান করেছেন। এমনকী নতুন করে রেকর্ডও করেছেন। একদা-তারকা-অধুনা-প্রৌঢ় শিল্পীকে চোখের সামনে গান গাইতে দেখে ধন্য হয়েছি আমরা। কিন্ত হাঁপ-ধরা, গতিহীন, কালের অমোঘ কামড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত গায়কি শুনে সহানুভুতিশীল রসিক মানুষের কষ্ট হওয়ার কথা তাঁদের জন্য। ক’জনের হয়েছে কে জানে।
বাংলায় আধুনিক গায়কি, পরিশীলিত ও পরিমিত স্বরপ্রক্ষেপ, সাবেক আধাগ্রাম্য উচ্চারণরীতির বদলে নাগরিক উচ্চারণরীতির জনক পঙ্কজ কুমার মল্লিক একটা বয়সের পর গান গাওয়ার দুনিয়া থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তার পর তিনি শুধু আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সংগীতশিক্ষার আসর পরিচালনা করেছিলেন।
ক’জন বাঙালি একদা-তারকা অনুসরণ করতে পেরেছেন তাঁর দৃষ্টান্ত? |
|
|
|
|
|