|
|
|
|
|
|
|
জিতবই |
ওদের হেল্থ ড্রিংক নেই, কার্টুন নেটওয়ার্ক নেই। কেউ পঙ্গু, কেউ যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে,
কেউ পথে ঘোরে। তবু এই বাচ্চারা লড়ছে, পড়াশোনা আঁকড়ে। সীমান্ত গুহঠাকুরতা |
সুধার মাসি এসে শিক্ষকদের বলে গিয়েছিলেন, ওকে যেন মারধর না করা হয়। ওর নার্ভের একটা সমস্যা আছে আর পেটেও ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। কাহারপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইরা অবশ্য গত দু’বছরে মারধর তো দূরের কথা, সামান্য বকাঝকা করার মতো ত্রুটিও খুঁজে পাননি সুধার। স্কুলে শতকরা একশো দিন উপস্থিতি, পরীক্ষার নম্বরও চোখে পড়ার মতো ভাল।
উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর ব্লকের ইছামতীর ধারঘেঁষা কাহারপাড়ার আদিবাসী বস্তির বাসিন্দা এই সুধা মণ্ডল একরত্তি মেয়ে হলে কী হবে, রোজ সকালে একা একা স্নান করে, স্কুল-ড্রেস পরে, মাসির রেখে যাওয়া বিস্কুট আর জল খেয়ে স্কুলের পথে পাড়ি দেয়। সুধার মা ওকে ছেড়ে ‘নদীর ও-ও-ই ও পারে’ অন্য একটা লোককে বিয়ে করে চলে গিয়েছেন ওর জন্মের বাইশ দিনের মাথায়। বাবাকেও কোনও দিন দেখেনি সুধা। তিনি তো তার জন্মের আগেই উধাও।
সুধা তাই তার মাসি শ্রাবণী মণ্ডলের কাছেই থাকে। তিনি প্রতি দিন ভোরবেলা উঠে কাজে বেরিয়ে যান। রাস্তা মেরামতির কাজ, জমিতে চাষের কাজ যে দিন যা জোটে তা-ই করেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে। সুধা তত ক্ষণে স্কুল থেকে বাড়ি এসে পরিপাটি করে বই-খাতা খুলে পড়তে বসে যায়। মাসি বলেন, ‘আমাদের জাতের কেউ তো কোনও দিন চাকরিবাকরি পেত না, আজকাল পাচ্ছে। সুধা খুব মন দিয়ে পড়ে। তবে যা ভোগে ও, কত বার তো হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। টেস্ট-ফেস্টও করালাম এক গাদা। ডাক্তাররা রোগই ধরতে পারল না। শেষমেশ বাঁচাতে পারব তো মেয়েটাকে?’
পায়েলের যখন ছ’বছর বয়স, তখন থেকেই দু’পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে অসাড় হয়ে যেতে থাকে। এখন আর পায়েল নিজে নিজে প্রায় চলতেই পারে না। বর্ধমানের বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের ক্লাস সিক্সের ছাত্রী পায়েল দে তাই এখন মায়ের কোলে চড়েই স্কুলে যায়। ওর যখন মাত্র দেড় বছর বয়স, তখনই বাবা মারা যান। তাঁর কাঁধে একটা ফোড়া হয়েছিল, তার পর অপারেশন করতে গিয়ে বিভ্রাট।
পায়েলের মা পায়েলকে নিয়ে কম ছোটাছুটি করেননি। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সেই সুদূর বর্ধমান জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত দৌড়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ডাক্তাররা ব্যায়াম-ট্যায়াম করাতে বলে দায় সেরেছেন। কিছু দিন আকুপাংচারও করা হচ্ছিল। উপকার হচ্ছিল না বিশেষ কিছু। পায়েলের মা ইদানীং হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বর্ধমান জেলার মেমারির কাছে কড়ুরি গ্রামের এক প্রান্তে তাঁর বাড়ি, সেখান থেকে বার বার গাড়ি পালটে সপ্তাহে দু’দিন সেই জেলা সদরে ছোটাছুটি করার মত আর্থিক সামর্থ্য তাঁর নেই। রোজগারের উপায় বলতে মুড়ি ভাজা আর ঠোঙা বানানো। |
|
কখনও লোকের বাড়ি ফাইফরমাশ খেটেও এক বেলার ভাত জোগাড় করতে হয়। মেয়েকে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। তাকে যে বড় হয়ে ডাক্তার হতেই হবে। বাবার অসুস্থতার ভুল চিকিৎসার গল্প শুনেছে সে, নিজেকে দিয়ে বুঝেছে চিকিৎসাহীনতার যন্ত্রণা। তাই তার বরাবরের জেদ, স্কুল কামাই করা চলবে না।
পায়েলের মা তাই পায়েলকে নিয়ে স্কুলে যান, তার পর সারা দিন সেখানেই বসে থাকেন। মিশন কর্তৃপক্ষ পায়েলের মায়ের জন্যও দুপুরের খাওয়াটা বরাদ্দ করেছেন। বিকেলে মা-মেয়ে আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে, হ্যারিকেনের আলোয় ঠোঙা বানাতে বসে। পায়েল বলে, ‘মা একা বেশি পারে না তো, তাই আমিও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মাকে ঠোঙা বানিয়ে দিই। ঠোঙা বানানো খুব সোজা, মা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে।’
‘বাড়িতে একা থাকলেই ছেলেটা টেপ-রেকর্ডারে গান চালিয়ে আপন মনে নাচে’, বলছিলেন শেখ রোহিতের মা রুবি বিবি, ‘একেই তো আমাদের ধর্মে নাচ-গান নিষেধ, তার ওপর ছেলে-সন্তান হয়ে ওই সব ন্যাকা ন্যাকা ব্যাপার আমার শ্বশুর-শাশুড়ি একেবারেই পছন্দ করতেন না।’
শেখ রোহিত তখন বোলপুরের রবীন্দ্র শিক্ষানিকেতন নামের প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, সেই সময় স্কুলে এক জন নতুন দিদিমণি এলেন, যিনি অল্পবিস্তর নাচ জানতেন। স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রস্তুতির সময় তিনি রোহিতের মধ্যে নাচের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ দেখতে পেলেন। নিজের মতো করে তিনি তালিম দিতে থাকেন তাকে। রোহিত পুরো মজে যায় নাচে। কিন্তু ওদের বাড়িতে কঠোর শরিয়তি আবহাওয়া। দাদু-ঠাকুমা রীতিমত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন রোহিতের নাচ-গানের ওপর। আরও একটা সমস্যা ছিল, রোহিতের দিক থেকে অবশ্য সেটাই গুরুতর, ‘ওই বাড়ির আশেপাশে সব সময় কুড়ি-পঁচিশটা ছেলেমেয়ে খেলাধুলো করত। নাচ প্র্যাকটিস করলেই ওরা আমাকে নিয়ে মজা করত।’
রোহিতের মা রুবি বিবি তাই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছেন বাপের বাড়িতে। রোহিতের বাবা, পেশায় রিকশাচালক শেখ কামু মাঝেসাঝে আসেন, সাধ্যমত আর্থিক সাহায্য করে যান। বার বার বিবিকে অনুরোধ করেন বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু রুবি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সন্তানের স্বাধীন ভাবে বড় হওয়ার প্রতিকূল পরিবেশে তিনি মোটেই আর ফিরে যাবেন না।
রোহিত এখন বোলপুরের বাঁধগোড়া কালীকৃষ্ণ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। নাচও চলছে পুরোদমে। নানা অনুষ্ঠান থেকে ডাক আসে। সম্প্রতি বোলপুর টাউন লাইব্রেরির রবীন্দ্রজয়ন্তীতেও ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’র সঙ্গে নেচে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছে। রোহিতের মামারা একটু সংশয়ে আছেন নাচ নাচ করে পড়াশোনার না বারোটা বাজে। রোহিত অবশ্য বলল, ‘পড়তে তো ভালইবাসি। রোজ স্কুলে যাই, পরীক্ষাতেও ভাল নম্বর পেয়েছি। কিন্তু আমাকে নাচ শেখাবার মতো কেউ নেই। নিজে নিজেই গান বাজিয়ে নাচ তুলি। কেউ আমাকে একটা নাচের স্কুলে ভরতি করে দিচ্ছে না।’
মিনতি (নাম পরিবর্তিত) শতরঞ্চির ওপর মাথা নিচু করে বসে ছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দপ্তরে। বসিরহাটের ঘোঁজাডাঙা সীমান্ত এলাকার একটি গ্রামের বাসিন্দা মিনতি মা’র সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন এই ‘সেবাসদন’-এ আসে, কাউন্সেলিং-এর জন্য। |
|
মিনতির বয়স যখন তিন, তখন ওর বাবা পাগল হয়ে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাড়ির ভাড়া না দিতে পারায় ওরা মানে ওর মা আর ওরা তিন বোনআশ্রয় নিয়েছিল গ্রামেরই এক সম্পন্ন মানুষের গোয়ালঘরে। গোয়ালের এক দিকে থাকত খানতিনেক গরু আর এক দিকে ওদের চার জনের সংসার। মিনতি তখন সবে প্রাইমারি ছাড়িয়ে হাই স্কুলের গণ্ডিতে পা দিয়েছে। মিনতির মা লোকের জমিতে মজুরানি হিসেবে কাজ করতেন। গ্রামের এক পরিচিত লোকের পরামর্শে মিনতি আর তার থেকে এক বছরের বড় দিদিকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন দমদম নাগেরবাজারে এক বড়লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে। বাকিটুকু শোনা যাক মিনতির জবানিতেই:
‘ওটা একটা তিনতলা বাড়ি ছিল। আমার মতো অনেকগুলো ছোট-বড় মেয়ে ওখানে কাজ করত। রোজ সন্ধ্যায় অনেক লোক আর মেয়েমানুষ আসত বাড়িটাতে। ওরা এক-একটা ঘরে বসে মদ খেত। প্রথম প্রথম আমাকে আর দিদিকে ওদের মদ, জল এই সব দিতে হত। বাসন-টাসন মাজতে হত। তার পর এক দিন ওই বাড়ির বউদিদিমণি সন্ধ্যাবেলায় আমাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে দিকে ঘরটা বন্ধ করে রাখল। একটু পরে একটা লোক, মুখে খুব মদের গন্ধ, দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এল। তার পর ও আমার সঙ্গে খুব নোংরা নোংরা কাজ করতে লাগল। আমার শরীরে খুব ব্যথা করছিল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। এ রকম রোজ রোজ হত। আমার দিদির সঙ্গেও হত। তার পর এক দিন আমি আর দিদি বিকেলবেলা পাড়ার মোড় থেকে চপ কিনবার নাম করে বেরিয়ে অটো ধরে দমদম স্টেশনে চলে আসি। আমাদের কাছে দশ টাকা ছিল। তাই দিয়ে অটোর ভাড়া দিই। তার পর একটা ট্রেনে করে হাবড়া স্টেশনে চলে আসি। তখন তো আমরা কিছু চিনতে পারছিলাম না, তাই স্টেশনে বসে বসে কাঁদছিলাম। স্টেশনের দোকানদাররা আমাদের থানায় নিয়ে গেছিল। ওখান থেকেই পরের দিন মা আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে।’
মিনতির মা সেই ‘বিরাট বাড়ি’র মালিকদের চেনেন না, থানায় কোনও অভিযোগও দায়ের করেননি তাদের বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, ‘আমরা গরিব মানুষ বাবা, ও সব পুলিশ-টুলিশের কাছে গিয়ে কি নিজেদের বিপদ বাড়াব?’ অনেক খুঁজেপেতে এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়ে, দীর্ঘ দিন কাউন্সেলিং করিয়ে মেয়েকে সুস্থ করে তুলেছেন। মিনতি এখন আবার তার পুরনো স্কুলে পুরনো ক্লাসেই ভরতি হয়েছে। গ্রামের প্রান্তে এক মৃত বৃদ্ধার পরিত্যক্ত বাড়িতে গ্রামের মানুষদের অনুমতি নিয়ে ওরা থাকে মিনতি আর তার মা। বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন রোজ সকালে মিনতির মা মাঠে যান কাজ করতে আর মিনতি যায় স্কুলে। এ ছাড়া বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হয় না সে। তবে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। ‘বড় হয়ে আমি কী করব জানি না, তবে এক জন ভাল মানুষ হতে চাই, সেই বড় বাড়িটার লোকগুলোর মতো না।’ মাথা নিচু করে, খুব মন দিয়ে শতরঞ্চির সুতো খুঁটতে খুঁটতে মৃদু স্বরে বলল মিনতি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরের কাছে জগদ্দলের রথতলার মোড়ে যে বড় শনিমন্দিরটা আছে, তার মার্বেল-বাঁধানো চাতালে দুপুরবেলা বাবা তারক দেবনাথের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শুভ। ওই সময়টায় প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায় না, তাই রিকশাটা মন্দিরের লোহার গ্রিলে চেন দিয়ে বেঁধে বাপ-ব্যাটায় একটু ঘুমিয়ে নেয়। কাছেই বস্তিতে ওদের একটা ঘর আছে বটে, কিন্তু দুপুরে আর রাতে সেখানে একা-একা থাকতে আট বছরের শুভর বড্ড ভয় করে। সেই তিন বছর বয়সে শুভর মা ওকে আর ওর বাবাকে ছেড়ে ‘অন্য একটা লোককে বিয়ে করে’ চলে গিয়েছিলেন।
দু’বছর হল, স্থানীয় একটি মিশনারি সংস্থা ‘বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব চিলড্রেন’-এর মাস্টারমশাইরা শুভর বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ওকে ভরতি করে নিয়েছেন নিজেদের স্কুলে। খুব ভোরে শুভর বাবা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান। শুভ ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই হাত-মুখ ধোয়, তার পর পাড়ার মোড়ের দোকানে গিয়ে পরোটা আর আলুর তরকারি খায়। বাড়ি ফিরে খানিক পড়াশোনা, তার পর স্নান-টান করে স্কুল। স্কুলেই ভাত দেওয়া হয়। ‘বিকেল আর সন্ধেটা বাবার সঙ্গেই থাকি’, বলছিল শুভ, ‘বাবা রিকশায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে যেখানে যেখানে যায়, আমিও সামনের রডে বসে যাই। আর কোনও পোল বা কালভার্ট পার করতে গিয়ে বাবাকে যখন রিকশাটা টেনে উঁচুতে তুলতে হয়, আমি নেমে গিয়ে পিছন থেকে রিকশাটা ঠেলে দিই। বাবার খুব কষ্ট হয় তো।’
তার পর, রাতে বাড়ি ফিরে মোমবাতি আর মশার ধূপ জ্বালিয়ে পড়তে বসে শুভ। তার আগে অবশ্য হোটেল থেকে বাবার সঙ্গে ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে আসে। ও ছবিও আঁকে। পাড়ার রাস্তাটা যেখানে গিয়ে হাই রোডে পড়েছে, সেখানে দাঁড়ানো ট্র্যাফিক পুলিশের ছবি এঁকেছে শুভ। বড় হয়ে সে পুলিশ হবে, আর সেই লোকটাকে ধরে জেলে পুরে দেবে যে তার মা’কে নিয়ে চলে গেছে।
‘নীলু হরিণের মতো দৌড়োয়, অসাধারণ ফুটবল খেলে, কিন্তু খালি পেটে কি খেলাধুলো করা যায়?’ আপশোস করছিলেন গোবরা কুবিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিজিৎ চৌধুরী, ‘তাই ওর স্কুলে স্পোর্টসের দিন আমিই পকেট থেকে টাকা দিয়ে ওর জন্য কিছু স্পেশাল ডায়েটের ব্যবস্থা করি।’ নীলু সোরেন এখন আর ওই প্রাইমারি স্কুলে পড়ে না, গত বছর স্থানীয় কুবিরপুর হাই স্কুলে ভরতি হয়েছে পঞ্চম শ্রেণিতে, গত পরীক্ষাতেও সব বিষয়ে সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়েছে।
বোলপুর থেকে সিউড়ি যাবার পথে একডালিয়া মোড় থেকে লাল মাটির যে রাস্তাটা নেমে গেছে দু’পাশে ধানখেতের মধ্য দিয়ে, তা ধরে মাইল দুয়েক হাঁটলে পৌঁছনো যাবে নীলুদের গ্রামে। স্কুল ছুটি থাকলে নীলু সারা দিন গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। পাড়ার লোক কখনও ডেকে খাইয়ে দিলে খাওয়া হয়, না হলে উপোসেই কাটে দিন। নীলুর বাবা নেই। ‘বাবাটো কলের মিস্ত্রির কাজ কইরত। আগুনে পুড়ে মইরে গেল’ভাবলেশহীন মুখে বলল নীলু। তার পরই নীলুর মা ওকে নিয়ে চলে আসেন ওর এই মামার বাড়ির গ্রামে। এখানেই নীলু প্রথম স্কুলে ভরতি হয়।
নীলুদের কোনও স্থায়ী আস্তানা নেই। গ্রামের এক কোনায় পথের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে ওরা। গত তিন বছরে চার বার ঠাঁই বদল ঘটেছে ওদের। নীলুর মা প্রতি দিন সকালে রান্না করে নীলুকে খাইয়ে, নিজের খাবারটা বেঁধে নিয়ে জন খাটতে চলে যান সিউড়ি, বোলপুর, কখনও সুদূর রামপুরহাটেও। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে চলে যায় নীলু, স্কুল থেকে ফিরে সারা বিকেল মাঠে ফুটবল খেলে। যে দিন মা’র কাজ জোটে না, তিন বেলাই মুড়ি খেয়ে কাটায় নীলু আর নীলুর মা।
রোনাল্ডো বা মেসি-র নাম শোনেনি নীলু, কিন্তু মাস্টারমশাইদের কাছে শুনেছে ভাল খেলোয়াড় হতে পারলে নাকি স্পোর্টস কোটায় চাকরি পাওয়া যায়, তবে তার জন্য তাকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। ‘সম্প্রতি নানা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলে সাঁওতালদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আগে অধিকাংশই প্রাইমারির চৌকাঠ ডিঙাত না, ইদানীং প্রায় সবাই হাই স্কুলে যায়’, বললেন অভিজিৎবাবু, ‘কিন্তু ক্লাস সিক্স-সেভেনেই পড়াশুনায় ইতি ঘটিয়ে কাজেকর্মে জুটে যায়।’ নীলুর গল্পটা অবশ্য আলাদা হতে পারে। ‘আমি রোজ চারিঘণ্টা করে পড়ি। মাধ্যমিকটো আমি পাশ করবই।’ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে, মাটিতে পা ঠুকে বলে গোবরা গ্রামের নীলু সোরেন।
|
ঋণ: প্রতীচী ট্রাস্ট, মানিকপুর আহ্বান, গোকুলপুর সেবাসদন,
আশিস মুখোপাধ্যায়, স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ। |
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
|
|
|
|
|