|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: ভার্সেটাইলিজ্ম
|
গৌতম চক্রবর্তী |
যে আঁকে, সে সুরও বাঁধে। ব্রাজিলের চিত্রশিল্পী এবং রকগায়ক ডেনিস গার্সিয়া মান্দারিনো তার সঙ্গে ম্যানিফেস্টোও লেখেন। লাতিন আমেরিকায় বসে ২০০৭ সালে, পর্তুগিজ ভাষায় তাঁর লেখা ‘ভার্সেটাইলিস্ট ম্যানিফেস্টো’ই আজ ইংরেজি ভার্সেটাইল শব্দটিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ভার্সেটাইল শব্দটির অর্থ নিয়ে সব অভিধানই একমত: বহু ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দবিহারী বা বহুগুণান্বিত। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যেমন! এক দিকে ‘মোনালিসা’ বা ‘লাস্ট সাপার’ আঁকছেন, পাশাপাশি স্থাপত্যের নকশা তৈরি, পেশির অ্যানাটমি থেকে আকাশবিহারী বিমান অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। ডেনিস মান্দারিনোর ভার্সেটাইলিস্ট ম্যানিফেস্টো এই ধ্রুপদী সংজ্ঞায় অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিয়েছে। ‘একটি বিষয়ে কাজ করতে করতেই ভার্সেটাইলিস্ট বা বহুমুখী শিল্পী হওয়া সম্ভব।...মানুষ বহু বার চেষ্টা করতে করতে শিল্প-সক্ষম হয়, তার আয়ত্তের মধ্যে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ জানতে পারে’, লিখছে ম্যানিফেস্টো। উস্তাদ আমজাদ আলি খান যদি সরোদে বিভিন্ন রাগ বাজানোর পাশাপাশি সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রগানে সঙ্গত করতে পারেন, তাঁকে কি বলা হবে না ভার্সেটাইল? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যদি অপুর পাশাপাশি ভিলেন ময়ূরবাহন হয়ে ওঠেন কিংবা ‘কে তুমি নন্দিনী’ গেয়ে টুইস্ট নাচতে পারেন, তাঁর অভিনয়কলাকে কেনই বা বহুমুখী বলা যাবে না? ‘ভার্সেটাইলিজ্ম শিল্পিত অভিব্যক্তির সন্ধানে থাকে। যে অভিব্যক্তি মানুষ এবং সমাজকে উন্নীত করে, শিল্পীর নিজস্ব বোঝাপড়াকে সম্মান করে।’
একুশ শতকের এই ম্যানিফেস্টোর অন্যতম দিকচিহ্ন: মুক্তির সন্ধান। মুক্তি চাওয়া হয়েছে শিল্পের বাজার এবং কলা-সমালোচক...এই দুই অদৃশ্য হাত থেকেই। ‘ভার্সেটাইলিস্টরা অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোনও বাজারি চাহিদার কাছেই নতি স্বীকার করেন না’, জানাচ্ছে ম্যানিফেস্টো। লাইনটা পড়ে ডেনিসকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাংলা লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদক মনে হতে পারে। কিন্তু এই ব্রাজিলীয় শিল্পীর তত্ত্বসন্দর্ভ ছিল আরও গভীরে। ‘শিল্পের বাজার আর শিল্পকলা দুটো আলাদা মেরুর বাসিন্দা। শিল্পকলা আর শিল্পের বাজার যদি এক হয়, তা হলে ভ্যান গখ জীবদ্দশায় হতদরিদ্র থাকলেন কেন? আর তাঁর সেই ছবিগুলিই এখন কোটি কোটি ডলারে বিকোয় কী ভাবে? শিল্পের বাজারে টাকা খাটে বলে আমাদের আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সব কিছু বিচার করতে হবে। বিজ্ঞাপন, মিথ নির্মাণ, মিডিয়া এক্সপোজার, প্রশংসামূলক সমালোচনা, স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক সব কিছুই আজকাল শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে’, ইন্টারভিউতে ডেনিস।
একুশ শতকের শিল্পবাজার নিয়ে আরও অনেক কথাই বলেছেন তিনি। কোনও কোনও বিখ্যাত শিল্পী ক্যানভাসে আঁচড় কাটার আগেই ছবি বিক্রি হয়ে যায়। মানে শিল্পী যদি একটি সাদা কাগজে সই করে দেন, আর সেই সইয়ের ওপর আপনি যে কোনও ছবি বসিয়ে দেন, তা হলেই হল। বাজারে ছবিটির মূল্যমান তৈরি হয়ে যাবে। ‘এটা সাংঘাতিক! কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা নেই, শুধু সইয়ের দাম। আমরা ভুলে যাই, মানুষ এই পৃথিবীতে চিন্তা করতে এসেছে। শিল্প সেই ক্রিটিকাল চিন্তায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।’ |
|
শিল্প-সমালোচক অর্থ লগ্নি এবং পৃষ্ঠ কণ্ডূয়নের এই বিপুল বাজারেরই পেশাদার এজেন্ট। ‘ভার্সেটাইলিজ্ম মানুষকে বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা থেকে মুক্তি দিতে চায়, সে বিশ্বাস করে, শিল্প নিজেকে জানার অন্যতম পথ। শিল্পী সব সময় তাঁর সীমার মধ্যে থেকেও শিল্পচেতনার বিস্তার ঘটাতে চান। সেই পথে ভুলভ্রান্তি ঘটতেই পারে। রূঢ় সমালোচনাতেও শিল্পী তাই হতাশ হবেন না। তাঁর শিল্পচর্চার অধ্যায় পরীক্ষার অসীম প্রান্তর’, লিখেছে ম্যানিফেস্টো। সমালোচকের ভূমিকা সম্বন্ধে ডেনিস বরাবরই সন্দিহান। ‘শিল্পী কী করেছেন, কী করলে আরও ভাল হত এ সব নিয়ে কেউ যখন রায় দেন, কী হয় জানেন? শিল্প, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শনের ইতিহাসে স্রষ্টারা বারংবার যে অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন, সেই অবিচারই পুনরাবৃত্ত হয়।’ সেই কবে জীবনানন্দ কৃমিকীট খুঁটে খাওয়া সমালোচকদের কথা লিখেছিলেন! চিন্তার মানচিত্রে বাঙালি কবিতা এবং লাতিন আমেরিকান শিল্পীর ম্যানিফেস্টো আজও পরস্পরকে স্পর্শ করে যায়।
পাশের ছবিটি ২০১১ সালে ডেনিসের আঁকা। ৮০ বাই ১২০ সেমি ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন ব্লু অ্যান্ড অরেঞ্জ।’ প্রথাগত সমালোচক প্রথমেই প্রশ্ন তুলবেন, ল্যান্ডস্কেপ কোথায়? এখানে তো দুটিই ফিগার। উপবৃত্তাকারে জ্যামিতিক তরঙ্গ, তারই ওপর বসে আছে মেয়েটি। ভিজে পায়জামায় দাগ পড়েছে বৃত্তাকারে, বক্ষবন্ধনীতে সমান্তরাল রেখায়। পিছনে ভাসমান সাঁতারু পুরুষের পা ছোড়াতেও বিন্দুমাত্র বিস্রস্ত হয় না মেয়েটির মাথায় চুড়ো করে বাঁধা চুল। সাঁতারের দাপাদাপির এই ঊর্মিমুখরতায় কোনও নারী কি এ ভাবে স্থির হয়ে শুধুই পায়ের পাতা ডুবিয়ে জলে স্থির হয়ে থাকতে পারে? সামনে বাঁ কোণে থাকা লাঠিটিই কি মেপে দেয় তরঙ্গমালার পরিমাপ? কী আসে যায় এত সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া, না-পাওয়ায়? ছবিই তো সব! তার মধ্যেই সত্তার অমরত্ব।
শিল্পের মধ্য দিয়ে চরম ও পরম সত্তাকেই খুঁজতে চেয়েছে এই ম্যানিফেস্টো। প্রথম লাইনেই তাই বলা হয়েছে, ‘ভার্সেটাইলিজম-এর দর্শন একটিই। চূড়ান্ত বোধ (সুপ্রিম ইন্টেলিজেন্স)-ই আমাদের সত্তাকে সৃষ্টি করেছে, সত্তা অমর। কিন্তু সত্তাকেও ব্রহ্মাণ্ডের চলতি নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।’ শিল্পস্রষ্টা হিসেবে এলেন না স্বরাট শিল্পী। বরং এল বোধিসৃষ্ট সত্তা।
সত্তার অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাসী বলেই ভার্সেটাইলিজ্মে নেই কোনও শিল্প-প্রতিযোগিতা। ‘কোনও মানুষই অন্যের বিচার করতে সক্ষম নয়।...প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পুরস্কার ইত্যাদি স্রেফ জনমতে প্রভাব ফেলা, আর্থিক বা সামাজিক সুবিধে পাওয়ার উপায়।’ ব্রাজিলীয় ভার্সেটাইলিজ্ম জানায়, ভারতীয় টিভির রিয়ালিটি শো আর যাই হোক, শিল্প নয়।
ভার্সেটাইলিজ্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কোথায়? শিল্পী এখানে তাঁর সৃষ্টির ক্রীতদাস নন। চর্বিত চর্বণ থেকে বেরিয়ে তিনি যে কোনও মুহূর্তে অন্য সম্ভাবনার খোঁজ করতে পারেন, উৎসে ফিরতে পারেন। মানুষ সব সময় এক গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না। ইন্টারভিউতে ডেনিস এক জ্যামিতি-শিক্ষকের কাহিনি শুনিয়েছিলেন। তিনি সকালে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি শেখান, ‘দুটি বিন্দুর মধ্যে সরলরেখাই ন্যূনতম দূরত্ব।’ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সময় ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বদলে সলিড স্টেট জিওমেট্রি ব্যবহার করেন। প্রতিটি মানুষই ভার্সেটাইল বা বহুমুখী।
মনে পড়ছে পরিচিত এক বঙ্গসন্তানের প্রতিধ্বনি? অমর্ত্য সেন তাঁর ‘আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ বইয়ে মানুষের বহুমুখী পরিচিতির কথাই বলেছিলেন। কোনও বৈপরীত্য ছাড়া এক জন মানুষ একই সঙ্গে আমেরিকান নাগরিক, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, খ্রিস্টান, উদারনৈতিক, শাকাহারী, বিসমকামী অনেক কিছুই হতে পারে। একই সঙ্গে সে সমকামী আন্দোলন সমর্থন করতে পারে, মহিলা, নারীবাদী, পরিবেশপ্রেমী অনেক কিছুই হতে পারে! সেটাই মানুষী পরিচিতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে যখন একটি পরিচিতির খোপই বড় হয়ে ওঠে, তখনই হিংসার জন্ম।
কে জানত, সমাজদর্শন এবং শিল্পের ম্যানিফেস্টো এই দুনিয়ায় পাশাপাশি! |
|
|
|
|
|