শিশু ও শয়তান
ভোর পাঁচটা
সেই যিনি বলে গিয়েছিলেন যে, ভোর পাঁচটায় পড়লে পড়া দারুণ মনে থাকে, সর্বনাশটা তিনিই করে গিয়েছিলেন। তাঁর কথা মেনেই কি কিন্ডারগার্টেন স্কুলমাত্র সাড়ে ছ’টার মধ্যে খোলে? রবীন্দ্রনাথের গর্ব ছিল, সূর্য কোনও দিন তাঁকে হারাতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ মাথায় থাকুন তাঁর গর্ব নিয়ে, সেই যে বছর আড়াই বয়স থেকে, সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুম থেকে ওঠার কম্পিটিশন শুরু হয়, বড়বেলাটা না আসা ইস্তক ওই রেস থেকে রেহাই নেই। স্কুল যদি অমন কাকভোরে না-ও থাকে বা একটু বেলা করেও শুরু হয়, তা হলেই বা ছাড়ছে কে? সাতসকালে থাকবেই থাকবে শরীর কসরত, গানের রেওয়াজ, সাঁতারের ক্লাস, সাতটা বাজতে পাঁচের সায়েন্স স্যর ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সব থেকে তিতকুটে ভোরবেলা শনি ও রবির। কারণ, হলিডে শব্দটা ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ। সারা সপ্তাহ স্কুল-কোচিং-এক্সট্রাকারিকুলারে পরিশ্রান্ত ছোট্ট শরীরমনগুলোর একটু বিশ্রাম চাই না? ঘুমে থইথই চোখ আর আর যন্ত্রণায় দপদপে কপাল নিয়ে ড্রয়িং স্কুলে গেলে, ভেবেচিন্তে ভাল ভাল ছবি আঁকবে কী ভাবে? ব্রেন তো তখন বিশ্রাম চাইবেই! শরীরও ঘুমের বায়না জুড়বে। তখন সেই অনিচ্ছুক শরীরটাকে মারতে ঠেলতে মাঠে টেনে নিয়ে গেলে, খেলার প্রতি ভালবাসাটাই বা কোত্থেকে জন্মাবে? এ সব শুনছে কে? শুধু যুগ যুগ ধরে সবাই জেনেছে: আজি এ প্রভাতে রবির কর যেই না পশিল ঘাড়ের ’পর, বাছা রেএএ তুই ঘুম থেকে উঠে জীবনের সাথে যুদ্ধ কর’। যত কষ্টের, নষ্টের গোড়া এই ভোরবেলা। ছোটবেলাটায় তার আসার দরকারটাই কী? এত বয়েস হল, সূর্য একটু বেলায় উঠলে পারে না?

স্টুডিয়াস ক্লাসমেট
বইপোকা তবু মাঝেমধ্যে এ-দিক ও-দিক ঘুরতে যেতে পারে, এই মহাত্মা স্কুলে আসতে আসতে পড়ছে, প্রেয়ার লাইনে হাঁটতে হাঁটতে পড়ছে, ক্লাসে বসে না সিলেবাসে বসে গুলিয়ে যাচ্ছে, টিফিনে ডিমসেদ্ধ খাচ্ছে না বইয়ের পাতা খাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না, বাড়িতে খেতে বসে নাকি মাংসের বাটির বদলে জলের গেলাসে রুটি চুবিয়ে দিব্যি খেয়ে নেয়, সামনে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস খোলা যে! বাড়ি যাওয়ার সময় জানলার সিট পেয়েও এক ঝলকও বাইরে দেখছে না, বইয়ে আটকানো পলক তার এক বারও পড়ছে না!!!
এ দিকে দুনিয়াশুদ্ধ আঙুল আর কটমটে চোখ বাকি ক্লাসের পুঁচকেগুলোকে খোঁচার পর খোঁচা দিচ্ছে। ‘ওকে দেখো’, ‘দেখে শেখো’, ‘ওর মতো হতে পারো না?’ (‘তুমি’ সম্বোধনটা তুলে দেওয়া উচিত। বকুনির সময় গায়ে বড্ড জ্বালা করে।) এত জ্বলুনির মধ্যেও কয়েকটা প্রশ্ন চুলবুল করে। ক্লাস টু’তেই রাত দুটো পর্যন্ত টানছে, ওর সিলেবাসটা কি অন্যদের চেয়ে বেশি? কিংবা ইয়ে, ঘিলুটা কম, কয়েক বার পড়েও মনে রাখতে পারে না? আর একটা ডাউট-ও উঁকি মারে, বইয়ের ফাঁকে কমিক-টমিক গুঁজে রাখেনি তো? শিয়োর? আচ্ছা আচ্ছা, স্রেফ একটা প্রশ্নেরই জবাব চাই আর। উঠতে-বসতে ওর উদাহরণ দাও, ওকে পারফেক্ট বলো, তার পরও ওকেই এত আহা-উহু কর কেন? কেন? কেন?

স্কুল ডায়েরি
বছরের শুরুতেই স্কুল থেকে তাকে ঘটা করে সাজিয়েগুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। স্পাই। বাচ্চার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি দেবে। প্রথম ক’পাতাতেই হাড় হিম নোটিস ছাপা: এত দিন স্কুল হবে, এই রুটিন, এই এই দিন পরীক্ষা, এই এই ডিসিপ্লিন, না মানলেই এমন এমন ভাবে ঘচাং। তার পর অনেক সাদা পাতা। দিন এগোবে, আর তারা সব গুপ্ততথ্য ফাঁস করবে: জানো তো, আজ টিফিনে চেঁচিয়েছে, আজ স্তবগুচ্ছ আনেনি, জানলা দিয়ে কুকুরকে ডেকেছে ও কান ধরে দাঁড়িয়েছে। কখনও কখনও খুদেকে দিয়েই তাতে ৫০ বার লেখানো হয়, ‘আমি আর অঙ্কখাতায় স্পাইডারম্যান আঁকিব না’। অতি অবশ্যই সবেতেই চাই গার্জেনের সই। ডায়েরি তো নয়, যেন থানায় দাগি আসামির কেস ফাইল। এফআইআর, অ্যারেস্ট, বাড়ির লোকের জামিন সব আছে। অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই ‘ডেঞ্জারাস ডায়েরি’ একাধিক। কারণ, গুচ্ছের প্রাইভেট টিউশন। প্রতিটি গোমড়াথেরিয়াম স্যর ও হাঁড়িমুখো ম্যাম পিছু একটি করে হোমওয়ার্ক লিস্টে বোঝাই, নালিশে স্পেশালিস্ট ডায়েরি তো থাকবেই।

ইভ কী খতরনাক
ইভ মানে আগের দিন। যেমন ক্রিসমাস ইভ। আহা, সে কী আনন্দের দিন! দারুণ জমকালো। ছোটদের জীবনেও গোটা কয় ইভ থাকে। কিন্তু তারা কালো ইভ। দত্যি-দানো ইভ। যেমন পরীক্ষা ইভ। যে সারা বছর তেমন পড়েনি, তার বেলা ইভখানি হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে যাবে। আবার যে সারা বছর ঠিকঠাকই পড়েছে, তার সঙ্গেও এই ইভ মহাশয়া ‘শেয়াল ও কুমিরছানা’ খেলবে। মানে, বহু বার জানা বিষয়কেই অজানা বলে বুঝিয়ে, হাজার বার গিলিয়ে দেবে। চেনা পড়াকেও ঘোর অচেনা বলে ধাঁধা লাগিয়ে দেবে। সন্ধেটি অতিশয় ধূর্ত। কী করে পড়ায় মন বসাতে বাধা দিতে হয় সে বিষয়ে পিএইচ ডি করেছে। রাজ্যের ঘুমকে নিজে থেকে নেমন্তন্ন করে করে ডেকে আনবে, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ, লোভনীয় কার্টুন শো, শহরে সার্কাস বেছে বেছে এ দিনই পড়বে। পিসি-মামারা যে যেখানে আছে, সক্কলে এই দিনই বাড়ি এসে দুরন্ত সব খোশগল্পের ঝাঁপি খুলে বসবে। তবে টর্চারে এই সন্ধেকে যে পাল্লা দেবে সে-ও অদূরেই আসিতেছে। রেজাল্টের ইভ। ম্যাজিক জানে। এসেই ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছিল’ কমপ্লিটলি ভুলিয়ে দেয়, খিদে-তেষ্টা-ঘুম’কে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট বুকটায় ভরে দেয় ব্রহ্মাণ্ডসমান টেনশন। ক্লাসে ফার্স্ট হব কি হব না, পাশ না ফেল না কি হার্টফেল? বিকেলে গার্জেন কল হবে না রাতে বিরিয়ানি খাব? সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট সওয়াল, কাল ঠিক এই সময় আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি তো? এই দুই জাঁহাবাজকে ডুয়েল লড়িয়ে দিলেই হয়। নিজেদের মধ্যে লড়ে ফৌত হবে, ছোটবেলা বেচারা একটু শান্তি পাবে।

একা শোওয়ার অন্ধকার
হাবেভাবে এক্কেবারে ডক্টর জেকিল মিস্টার হাইড। দিনের আলোয় মিষ্টি মিষ্টি বলবে, ‘বাবু আমি তোমার একলার স্টাডি, একলার বেডরুম’। আর দিনের শেষে সুইচ অফ হলেই? আমি বকরাক্ষস, ঘ্যাঁঘাসুর, কাউন্ট ড্রাকুলা/ হাহাহাহা!
এ বার পেয়েছি তোকে অকেলা
বাছাধন যাবি কোথা?
কেটেকুটে বানাব কালিয়া-কোপ্তা
ওই দ্যাখ্ দেওয়ালেতে ছায়া নড়ে
আয়নাতে কারা বুঝি যায় সরে
পুতুলেরা সব ফিসফিস করে
আলমারি-টপে ওই কেউ চড়ে!
একা তুই, তাই মোটে একা নোস রে
তোর সাথে আমি আছি, নাম যার একানড়ে!!!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.