মুম্বই ব্যাটিং ঘরানার আরও এক ক্রিকেটারের আবির্ভাব ঘটল। রোহিত শর্মা এমন এক জন ক্রিকেটার যে সব সময় তার সমালোচকদের ধন্ধে ফেলে দিয়েছে। যখন এই কলামটা লিখছি, তখন ইডেনে ওর দুর্দান্ত সেঞ্চুরি নিশ্চয়ই সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
রোহিতের প্রতিভায় সবার বিশ্বাস ছিল, কিন্তু ও কিছুতেই পারফর্ম করতে পারছিল না। কারও মধ্যে প্রতিভা আছে এই কথাটা বলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, কেউ জানে না সেই প্রতিভা কবে ফুটে বেরোবে। দিলীপ বেঙ্গসরকর যথেষ্ট প্রতিভাবান ছিল, কিন্তু একটা হাফসেঞ্চুরি পেতে ওর আটটা টেস্ট লেগে গিয়েছিল! তখনকার নির্বাচকেরা খুব নামী লোক ছিলেন। আর নিশ্চয়ই তাঁরা দিলীপের প্রতিভা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। না হলে ওকে অতগুলো সুযোগ দিতেন না।
রোহিতের ব্যাপারটাও এক রকম। টিনএজার হিসেবে ও নিজের কেয়ার-ফ্রি ব্যাটিং দিয়ে বোলারদের সঙ্গে প্রায় খেলা করত। কিন্তু ওকে দেখে মনে হত যে, নিজের উইকেটের দাম ওর কাছে খুব বেশি ছিল না। মুম্বইয়ের আর পাঁচ জন ব্যাটসম্যানের মতো কম বয়সে ‘খারুস’ ছিল না রোহিত। বরং ওকে দেখে বেশ খামখেয়ালি মনে হত। ওর অনূর্ধ্ব ১৭ মুম্বই কোচ বাসু পরাঞ্জপে ওকে বলতেন, “তোমার মতো প্রতিভা নিয়ে যদি তুমি বোলিং আক্রমণকে চূর্ণ না করো, তা হলে তুমি ভুল জায়গায় এসেছ।” তার ঠিক পরেই রোহিত দারুণ একটা সেঞ্চুরি করেছিল।
রোহিতের যখন সতেরো বছর বয়স, তখন বেঙ্গসরকরের মুম্বই নির্বাচন কমিটি ওকে অবশিষ্ট ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে দলে নিয়েছিল। তবে রোহিতের মধ্যে যতই প্রতিভা থাক, ও প্রচণ্ড খামখেয়ালি ছিল। মুম্বইয়ের তখনকার কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত এই ঘটনাটা নিয়ে বলছিলেন, “এনসিএ-তে রোহিতের একটা সেঞ্চুরি দেখে দিলীপ বেঙ্গসরকর ওকে ইরানি ট্রফির ম্যাচে নিয়েছিল। আমি তখনও ওকে দেখিইনি। তিন-চার দিন প্র্যাকটিসে আসেনি রোহিত। এক দিন এসে বলল ট্রেনে করে আসতে গিয়ে রেললাইনে ওর কিট পড়ে গিয়েছে। পরের দিন সিসিআই-এর নেটে কিট ছাড়াই ঢুকে পড়ল রোহিত। তখন আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম। পরে শুনলাম ও সিসিআই-এর কোনও একটা ঘরেই নিজের কিট রেখে এসেছিল। ওটা আর মাঠে আনেনি। দিলীপকে আমি বলেছিলাম রোহিতকে টিম থেকে বাদ দিতে, আর দিলীপ সেটা করেও ছিল। মুম্বই ক্রিকেটে আমরা বিশৃঙ্খলা সহ্য করি না।” |
বছরদুয়েক আগের ঘটনা। ম্যাচের আগে ওয়ার্ম-আপ ফুটবল খেলার সময় ওর পায়ে চোট লেগেছিল। ম্যাচটা খেলতে পারেনি রোহিত। তবু ওর মধ্যে কোনও আফসোস ছিল না। এই দৃঢ়তা আর বিশ্বাস থেকেই বোঝা যায় ওর ভেতরটা কত শান্ত। রোহিতের উপর টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা ছিল, আর মিডিয়ার কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচকেরা ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এত অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত ওর প্রতিভা স্বমহিমায় ফুটে উঠল, যখন বেঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০৯ করল।
এত বছরের অপেক্ষার পরিণতি যে এ রকম হতে পারে, সেটা দেখে মনে হচ্ছে কয়েক জন ক্রিকেটারকে হয়তো বাকিদের চেয়ে একটু বেশি সময় দেওয়া উচিত। ডারমট রিভের অধিনায়কত্বে যখন উর্স্টারশায়ারে ব্রায়ান লারা খেলত, তখনকার গল্প শুনতে শুনতে একটা গোটা সন্ধে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এই লারাই কিন্তু একটা টেস্টে অপরাজিত ৪০০ আর একটা কাউন্টি ম্যাচে ৫০০ করেছিল।
আমরা কি বলতে পারি যে, এ রকম স্পেশ্যাল প্রতিভার উপর আচরণের বিধিনিষেধ না চাপানোই ভাল? একটা অনূর্ধ্ব ১৯ ম্যাচ খেলে লোকাল ট্রেনে ফেরার সময় রোহিতের কিটব্যাগ ওর হাত ফস্কে রেললাইনে পড়ে গিয়েছিল। পরের স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কিটব্যাগটা নিয়ে আসার প্রয়োজন মনে করেনি রোহিত। লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে ধোনি যদি খারাপ হয়, তো রোহিত আরও খারাপ। নিয়মিত নিজের ব্যক্তিগত ইলেকট্রনিক জিনিস হারিয়ে ফেলে রোহিত। এত কিছুর পরেও ধোনি যে ওকে বুঝতে পেরে ওর পাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়।
ইডেন টেস্টের কথায় আসি। ওর টিম যখন বিপদে তখন রোহিত যে অলরাউন্ড স্ট্রোকগুলো খেলল, সেগুলোর জন্য টেম্পারামেন্ট দরকার। অভিষেক হোক বা অন্য আন্তর্জাতিক ম্যাচ, রান না পাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই একটু নড়বড়ে থাকে। আর ইডেনের মতো বিশাল মাঠের শিহরণ-জাগানো পরিবেশে দর্শকদের প্রত্যাশার চাপটা আরও বাড়িয়ে দেয়। সেখানে কিন্তু রোহিত বেশ রিল্যাক্সড ছিল।
ইডেনে ব্যর্থ হলে রোহিতকে টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে ব্যাটসম্যানের তকমা নিয়ে বাকি কেরিয়ার কাটাতে হত। কিন্তু সে সব বাধা টপকে গেল রোহিত। ধোনি যখন ওর সঙ্গে ব্যাট করতে নামল, তখন সব পরিস্থিতির কথাই ওর মাথায় ছিল। মুম্বইয়ের ব্যাটসম্যানরা অনেক আগেই এ সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ম্যাচটা খুব ভাল বুঝতে পেরেছিল রোহিত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজের ইনিংসটা খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছিল রোহিত। ধোনিকে বেশি স্ট্রাইক নিতে দিয়ে খুব পরিকল্পিত ভাবে স্ট্রাইক রোটেট করে যাচ্ছিল।
ধোনি আউট হয়ে যাওয়ার পর রোহিত আরও খোলা মনে খেলা শুরু করল। বলের লেংথ বেশ আগে বুঝে নিয়ে নিখুঁত টাইমিংয়ে গোটা মাঠে শট মারছিল। প্লেসমেন্ট অসাধারণ, মাথা ঠান্ডা, বুদ্ধিমান ব্যাটিং। ব্যাকফুটে ওর ড্রাইভ আর কাট একই সঙ্গে রাজকীয় আর নৃশংস।
রোহিত জানত যে শিলিংফোর্ড নিজের হাইটটা কাজে লাগিয়ে বিপজ্জনক বাউন্স পাচ্ছিল। রোহিতের দাওয়াই? ফ্রন্টফুটে প্যাড ব্যবহার করে স্পিনের গলা টিপে দেওয়া, না হলে একদম পিছনে চলে গিয়ে বলটা পায়ে পড়তে দেওয়া। টার্নিং উইকেটে ব্যাট করার এটাই সেরা টেকনিক। দিনের সেরা শট বাছতে বললে আমি বাছব শিলিংফোর্ডের বলে একটা মসৃণ লেট কাট। লেট কাটের চ্যাম্পিয়ন বিজয় মার্চেন্টও যেটা দেখলে গর্বিত হতেন।
রোহিতের সমস্যা হল, চ্যালেঞ্জ না থাকলে ও নিজের সেরাটা দিতে পারে না। ওর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে দশ বারের মধ্যে ন’বার প্রতি-আক্রমণে ও নিজের জমি ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু এই যে টেস্টে ওর শুরুটা এত ভাল হল, এখন ওকে কোহলির মতো নিজের জায়গাটা আরও মজবুত করতে হবে। ওকে নিজের আলসে আভিজাত্যটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট করতে হবে। |