প্রবন্ধ ১...
খাবার চিনলে খিদে বাড়ে
কাল আটটার মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে এসে জিনিসপত্র লকারে রেখে, টেবিলে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসে। সামনে ডকুমেন্ট প্রোজেক্টরে আমি একটা আকর্ষণীয় বই রেখেছি। পড়ে শোনাব। দরজার কাছে ব্রেকফাস্টের ট্রলি। নতুন পলিসির গুণে সারা হিউস্টন শহরের সমস্ত সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রী বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যকর জলখাবার পাচ্ছে। পড়াশোনার সময় বাঁচাতে ক্লাসরুমেই জলখাবারের পরিবেশনা। সময়টায় শুধু কাগজ পেনসিলের মকশো না করে, আমার নেশা ছিল ছোটদের কাছে তাদের না-পড়া, না-দেখা পৃথিবীর কিছুটা তুলে ধরা। হঠাৎ এই জলখাবারের সূত্র ধরে উঠে এল এক নতুন সম্ভাবনা।
আমেরিকায় সবই প্যাকেজ। বিয়ে থেকে আলুভাজা অবধি। স্কুলের খাবারও তাই। ট্রে-তে করে নানা রঙিন ঠোঙায়: বার্গার বা প্যানকেক, আপেল বা কলা। জুস আর দুধ আলাদা বাক্সে। বাচ্চারা তাতে একটু কামড় দিয়ে খাওয়ার কাজটা কোনও রকমে সেরে অপ্রিয় খাবার, ট্রে সমেত, ময়লার ড্রামে ফেলে দেয় ভাবলেশহীন ভাবে। আমি রোজ পড়াতে পড়াতে দেখতাম কী হারে খাবার নষ্ট হচ্ছে। এ দিকে পেট খালি, তাই মেজাজ তিরিক্ষি, আর কিছু ক্ষণ পরেই ঘুমে ঢুলে পড়া। পড়াশোনার হাল তথৈবচ।
খাবারও এ দেশে এক সামগ্রী। কী দিয়ে, কী ভাবে তৈরি, কোত্থেকে আসছে: কেউ মাথাও ঘামায় না। ভাল লাগলে খাও, নয়তো ফেলে দাও। ক্লাসের বাইশ জন পড়ুয়ার কেউ কেউ আপেলে একটা কামড় দিয়ে বা গোটা কলাটা না ছুঁয়েই ফেলে দিত। ক্লাসের অনেকেই এ-ডি-এইচ-ডি’র ওষুধ খেত, সারা দিন শান্ত থাকার জন্য। তার সাইড এফেক্ট-এ খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায়। মুখে রুচি নেই অথচ খালি পেটে দিন কাটিয়ে মেজাজ সপ্তমে। ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকত।
একটা বিহিত না করলেই চলছিল না! দু’তিন সপ্তাহ ধরে বুঝিয়ে কিছু হল না। উলটে কয়েক জন আমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য আরও নষ্ট করতে উঠে পড়ে লাগল। বুঝলাম এতে ফল হবে না। এক দিন আইডিয়াটা যেন নিজেই টুপ করে ধরা দিল, আর সেই থেকে শুরু হল বছর জুড়ে একটা খাদ্য অভিযান।
আমার ক্লাসে নকল ডলার-ব্যাংকের কারবার চলত বছরের শুরু থেকেই! এই ছোট্ট ডলার নোট বানাবার জন্য আমাকে অবশ্য কখনও জেল যেতে হয়নি। বরং মিছিমিছি হলেও, দশ-বারো বছরের বাচ্চারা শিখেছে ব্যাংকের চেক লেখা, টাকা তোলা, হিসেবের রেকর্ড রাখা আর মাথা খাটিয়ে অর্থব্যয় করা। এই ব্যাঙ্কিং-কর্মকাণ্ডে অনেক খাটুনি হলেও, আমার খাদ্যাভিযানের সাফল্যে তার বড় ভূমিকা আছে।
ক্লাসরুমটা যেন একটা শহর, সবার কোনও না কোনও চাকরি ছিল, ক্লাসরুমেরই ছোট বড় দায়িত্বকে ঘিরে। সেই বুঝে কারও বেশি মাইনে, কারওর কম। বানানো ডলারে, প্রত্যেককে তাদের ডেস্ক-চেয়ারের ভাড়া দিতাম আমি। সামনের সারির ডেস্কগুলোর ভাড়া বেশি। লাস্ট বেঞ্চের ভাড়া সব থেকে কম। রোজগারের আর এক পথ: বোনাস আর লটারির টিকিট। কেউ ভাল কাজ করছে দেখলেই তার বোনাস হত ১০০ ডলার বা একটা টিকিট। যেমন, ক্লাসের পরীক্ষার ভাল ফল, হোমওয়ার্ক সময় মতন জমা দেওয়া, সহপাঠীকে সাহায্য করা ইত্যাদি। ভাল ব্যবহারের রিওয়ার্ড সিস্টেমের ফলে গুটিকতক ডাকসাইটে ভেটারান ছাড়া প্রায় সবাই ভাল আর দায়িত্ববান হওয়ার চেষ্টা করত।
ওই ডলার খরচ করার ভীষণ লোভনীয় উপায় ছিল আমার শুক্রবারের দোকান। সপ্তাহ-শেষের ‘স্টোর টাইম’-এ ছাত্রছাত্রীরা ওই মিছিমিছি ডলার দিয়ে নানা রকম টুকিটাকি কিনতে পারত, বিশেষ কিছু জিনিসের নিলামে যোগ দিতে পারত। লটারিও ছিল। যার যত টিকিট, তার জেতার সম্ভাবনা তত বেশি। সবাই তাকিয়ে থাকত শুক্রবারের দিকে। এই অর্থ উপার্জন মোটিভেশনের দুর্দান্ত অস্ত্র।
ব্রেকফাস্টের সময় নিজেও একটা আপেল চিবোতে চিবোতে আপেলের বীজ দিয়েই গল্প শুরু করলাম। জনি অ্যাপ্লসিড-এর সারা আমেরিকায় আপেলের বীজ পোঁতার গল্প যত ক্ষণে শেষ, আমার হাতের আপেলটা তত ক্ষণে মাঝখানের বোঁটায় এসে ঠেকেছে। স্টুডেন্টরা হাঁ করে দেখছে আমার খাওয়া। বললাম, আর কেউ এ রকম করে খেলেই ১০০ ডলার বকশিশ। অমনি যাদের হাতে আপেল ছিল বা আদৌ খাবে কি না ভাবছিল, তারা নিমেষে তৎপর। তুড়ি মেরে ১০০ ডলারের নোটটা তুলে ধরলাম শূন্যে। অমনি খচমচ চিবোনোর আওয়াজে ক্লাসটা মুখর। হাতে হাতে ডলার গুঁজে দিতে দিতে দেখছি কয়েক জন তখনও আপেলটাকে জরিপ করছে। বুঝলাম, গল্পটা এখনও শেষ করা যাবে না। নিয়ে চলে গেলাম ওদের সুদূর এক আপেল বাগানে, ডালে ডালে মুকুল ধরা থেকে চাষির স্বপ্ন বড় হয়ে চলেছে পাকা মিষ্টি ফলটাকে ঘিরে, কত মাসের দিনগোনা, কত শত ট্রাকের কত দিকে কত শত মাইল ডিঙিয়ে বাজারে বাজারে পৌঁছে দেওয়া। ভোর রাত থেকে স্কুলের রান্নাঘরের কর্মচারীরা এগুলো ধুয়ে মুছে ট্রলিতে করে পৌঁছে দিয়েছে প্রত্যেকের হাতে হাতে; এত লোকের এত পরিশ্রম শুধু কি আপেলগুলোর আঁস্তাকুড়ে যাবার জন্য? ওরা সমস্বরে বলে উঠল: নোওওও! বুঝলাম, অল্প গলা কাঁপানো নাটকীয়তা যথেষ্ট কাজে লেগেছে! এও বুঝলাম, আপেল নিয়ে এমন করে ওরা আগে কক্ষনও ভাবেনি। নিয়ম হল, ফল, জুস বা দুধ না খেলে, আমার টেবিলে জমা রাখবে এঁটো না করে। এই ফুড-ব্যাঙ্ক থেকে যে কেউ পরে খেতে পারবে।
দিনের পর দিন বিভিন্ন খাবার তৈরির গল্প, এডুকেশনাল ভিডিয়ো, খাবারের কারবারে কত মানুষ কাজ করে, শরীরে পুষ্টির কত প্রয়োজন: আলোচনা চলল। বাস্কেটবল স্টার হবার স্বপ্ন দেখে ক্লাসের প্রতিটি ছেলে। ‘ইফ ইউ ওয়ানাবি অ্যান এনবিএ স্টার, টেক আ বাইট। ওয়ানা মোর মাস্ল্স্? টেক টু বাইটস্।’ মোটিভেশন ফল দিল। ডলার বিলি হয়ে গেল নিমেষে। শুক্রবারের নিলামের দর গেল চড়ে, মনিহারি দোকানের টুকিটাকি মহানন্দে বেচাকেনা হয়ে গেল, লটারির উত্তেজনাও দেখবার মতন। দুপুরবেলা ঢুলুঢুলু চোখের বদলে পেলাম চকচকে চাউনি।
নেশা চেপে গেল আমার। ঘোষণা হল, ব্রেকফাস্ট থেকে লাঞ্চ, পুরো ট্রে-র খাবার খেয়ে নিলেই ২০০ ডলার প্রাইজ! ছেলেমেয়েরা খাবার খেয়ে ট্রে উলটিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিতে লাগল। ডবল বোনাসের টোপ ভারী ফলপ্রসূ! হোঁচট খেলাম বার্গারে এসে। কেউ রুটির অংশটা ফেলে দিতে চায় তো কেউ মাংসটা। ঠিক করলাম বার্গারের চুলচেরা ভাগ করে বিশ্লেষণ করব। পাউরুটির গাছ ক’জন দেখেছ? বলামাত্র ধাঁ করে হাত তুলে দিল অনেকে! পাউরুটির উৎস, চিজের উৎস, নুন কোথা থেকে আসে, টম্যাটো, লেটুসের গাছ কত রকম: বার্গার নিয়ে রীতিমত ফুড-ম্যাপ তৈরি হয়ে গেল বোর্ডে। চিজের গোড়ার কথা যে গরুর দুধ, সেটা ওদের অনেকেরই মাথায় আসতে সময় লেগেছে।
খাবারের প্রতি ছোটদের অবহেলা অনেকটাই বদলে গিয়েছিল খাবারের উৎসের সন্ধান জেনে। এই পরিচিতির পর্বটা হয়তো একটু বেশি দীর্ঘ। তবু এই পথ চলাটা ক্লান্তিকর তো হয়নিই, বরং তৃপ্তি পেয়েছি আমরা সবাই। আশা রাখি, এর রেশ থেকে যাবে ওদের ভবিষ্যতেও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.