মেয়েরা আন্দোলনে এসেছে, প্রশ্ন তুলেছে। উত্তর পায়নি। জাতীয়তাবাদী
থেকে
মাচো বিপ্লবী, সবাই নারীর মধ্যে প্রেম আর সংসারের ম্যাজিক খুঁজেছে। লিখছেন
গৌতম চক্রবর্তী |
টালিগঞ্জে এমনই কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে লুকিয়ে ছিলেন নকশাল নেতা উদয়ন মিত্র? আর তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী গৌরীকে দাঁড় করিয়ে সি আর পি অফিসার চেঁচাচ্ছিলেন, “বেরিয়ে আসুন। নইলে এখনই গুলি করব।”
এই জায়গাটা টালিগঞ্জ নয়। সময়টা সত্তরের দশকও নয়। কবরডাঙা মোড় ছাড়িয়ে নেপালগঞ্জ হয়ে যে ভাঙাচোরা রাস্তাটা বোড়ালের দিকে চলে গিয়েছে, সেখানেই আজ ‘পার্পল মুভি স্টুডিয়ো’। রাস্তার দু’ধারে জলা জমি, কচুরিপানা, ধুনচে গাছ। ফলে মনে পড়ে গেল উদয়নকে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে ঝুম্পা লাহিড়ির সাম্প্রতিক উপন্যাস দ্য লোল্যান্ড-এর অন্যতম নায়ক উদয়ন।
অনুষঙ্গটা তৈরি হয়েছিল স্টুডিয়োর সৌজন্যে। সুধীর মিশ্রের ছবি ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’-র দশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। ছবিটি নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। কলকাতায় বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত কে কে মেনন ভোজপুরের গ্রামে আন্দোলন করতে যায়। বন্ধু শাইনি আহুজা দিল্লিতে নেতা ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজসের ফিক্সার। এদের বান্ধবী চিত্রাঙ্গদা সিংহ আমেরিকায় ভারতীয় আমলাকে বিয়ে করে দেশে ফিরে আসে। স্বামীকে লুকিয়ে কে কে মেননের সঙ্গে ভোজপুরে থাকতে যায়। দু’জনে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। শাইনি বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের মারে পঙ্গু। বিপ্লবী কে কে মেনন আমেরিকায়। চিত্রাঙ্গদা শাইনিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকেন।
জনসংস্কৃতিতে সাহিত্য, সিনেমা, সবই এক ধরনের ‘রেপ্রেজেন্টেশন’ বা উপস্থাপনা। ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ’র গীতা বা ‘লোল্যান্ড’-এর গৌরী কেউই পার্টি-সদস্য নয়। মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’, সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’র নায়িকা মাধবীলতাও তাই। পুত্র বা প্রেমিকের ওপর পুলিশি অত্যাচারই এদের প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’ ছবিতে নকশাল ধৃতিমান পুলিশকে এড়াতে সিমি গ্রেবালের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেন। সিমি পার্টিসদস্য নন। বিপ্লবী ভাই মৃত, ফলে ধৃতিমানকে শেল্টার দিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা জানায়, পারিবারিক কারণেই শহুরে মেয়েরা এগিয়ে এসেছিল। বিপ্লবের টানে নয়। |
‘কালবেলা’ ছবির একটি দৃশ্য। |
আসলে, এ দেশে বাম, অতিবাম, সবাই উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী ছকে খেলেছে। ইতিহাসের শূন্যস্থান ভরাটের চেষ্টা করেনি। শূন্যস্থান কোথায়? উনিশ শতকে নারীশিক্ষার প্রসার, সতীদাহ রদ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ইত্যাদি আন্দোলন মূলত উচ্চবর্গের পুরুষদের প্রয়াস। নারীশিক্ষা কেন? মেয়েরা ভাল স্ত্রী এবং মা হতে পারবে। কিন্তু দেবী চৌধুরাণীকে শেষে প্রফুল্ল হয়ে বাসন মাজতে হবে।
কমিউনিস্ট পার্টির জেনেটিক গড়নও তেমনই। পার্টির মেয়েরা তাদের সমস্যার কথা আলোচনা করেছিলেন জেনে লেনিন ক্লারা জেটকিনের কাছে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। বিপ্লব সম্পূর্ণ হলেই তো নারী-পুরুষ অসাম্য দূর হয়ে যাবে! জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্ট পার্টি কেউই পিতৃতান্ত্রিক কক্ষপথ ছেড়ে বেরোয়নি।
মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দেশভাগ। মেয়েরা বদলায়। অশনি সঙ্কেত পেয়ে ভাত জোগাড় করতে তাদের শরীরও বিক্রি করতে হয়। কমিউন গড়তে নয়, বেঁচে থাকার তাগিদেই ভাঙতে থাকে ‘সতীত্ব’র ধারণা। বিপ্লব নয়, বাপ-ভাইকে বাঁচাতে নীতাদের মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে।
কত তারাই যে তখন মেঘে ঢাকা! সুলেখা সান্যালের চমৎকার একটি গল্প ছিল। বাড়িতে দুই জা। বড় জায়ের খাটতে খাটতে দম বেরিয়ে যায়, দেওর এবং ছোট জাকে সে ঈর্ষা করে। দেওর কারখানার শ্রমিকদের হয়ে লড়াই করে, তাকে পুলিশের গাড়ি তুলে নিয়ে যায়। ছাঁটাই হওয়া বড় ভাই সংসার চালাতে অন্য কারখানায় ছাঁটাই শ্রমিকের বদলি হিসেবে যোগ দিতে চায়। তার স্ত্রী, সেই বড় জা চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি না ওর দাদা?’
বাম, অতিবামরা এ স্বর শোনেনি। সমাজতান্ত্রিক না জনগণতান্ত্রিক, বিপ্লব কোন পথে এগোবে, সেই তর্কেই তখন ব্যস্ত তারা। অথচ, সত্তরের দশকে মেয়েরা সহপাঠিনী। পার্টি না করলেও বন্ধুদের পাশে এগিয়ে আসে। শৈবাল মিত্রের ‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাসে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে বোমাবাজির আগে তপুকে সহপাঠিনী নীপা বলে, ‘তোমরা থাকলে আমরাও থাকব।’ সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’য় মাধবীলতা পুলিশের মার খেয়েও অনিমেষকে বলে, ‘আমার জন্য তুমি হেরে যেও না, লক্ষ্মীটি।’ চারু মজুমদারের দলিল মেয়েদের কথা না বললেও গল্প উপন্যাস সিনেমা তাদের ভোলেনি।
গল্প-উপন্যাস-সিনেমা এক ধরনের কাল্পনিক ইতিহাসের বয়ান। আন্দোলন শেষেও সেই বয়ানে অস্বীকার করা যায়নি মেয়েদের। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে প্রাক্তন নকশাল অঞ্জন দত্ত গাড়ি-বাড়ির মোহে মুগ্ধ। প্রেমিকা মমতাশঙ্কর তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কিশোরী মেয়ের মনে বিপ্লবী প্রেমিক কী প্রভাব ফেলত, তার দৃষ্টান্ত অপর্ণা সেনের ‘ইতি মৃণালিনী’। হৃদরোগে আক্রান্ত নায়িকার চোখে চার যুগ আগের ফ্ল্যাশব্যাক। কিশোর বয়সের প্রেমিক পুলিশের তাড়ায় ছুটছে। তার পরই বুলেটের শব্দ, সব অন্ধকার।
সুধীরের ছবিতে চিত্রাঙ্গদার নাম গীতা। এ দেশে বহু মেয়ের নাম ওই ধর্মগ্রন্থের নামে। সেখানে ভাই, বন্ধু, জ্ঞাতিদের কেন মারব ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। কিন্তু সারথি-ঈশ্বর যথার্থ জবাব দিতে পারেননি। একাদশ অধ্যায়ে তাই বিশ্বরূপ দর্শন। অর্থাৎ ম্যাজিক!
নকশাল আন্দোলনের মেয়েরাও প্রশ্ন তুলছিল। আন্দোলন জবাব দেয়নি। মাচো বিপ্লবীও নারীর মধ্যে প্রেম ও সংসারের ম্যাজিক খোঁজে! |