খেলাধুলা ১...
সামি এক্সপ্রেস
মাথাটা নাড়তে নাড়তে প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন শেন ওয়াটসন। রাঁচিতে অস্ট্রেলীয় অলরাউন্ডারের মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের সামির বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার সময়ও ঘোর যায়নি চোখমুখ থেকে।
ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার। সঙ্গে সুইং। অফস্টাম্পের বাইরে। আপাত নির্বিষ। হাত নিশপিশ করে উঠেছিল ওয়াটসনের। তাতেই পুরো বোকা বনে গেলেন। সামির নিয়ন্ত্রিত সুইং ব্যাট-প্যাডের ফাঁক খুঁজে আছড়ে পড়ল উইকেটে।
শুধু কি একা ওয়াটসন? তার আগে অ্যারন ফিঞ্চ, ফিলিপ হিউজেসদেরও হিমশিম খেতে দেখলাম। ওই ম্যাচটার পরে কেমন যেন হইচই পড়ে গেল সামিকে নিয়ে।
টেস্টেও ডাক পেল। যদিও এই লেখার সময় ইডেন-ম্যাচ শুরু হয়নি। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শেষ। গোটা সিরিজে ভারতীয় বোলাররা বেধড়ক মারধোর খেলেও সামি কিন্তু তার মধ্যেও আলোচনায়।
বাংলার এই স্পিডস্টারের পারফরম্যান্সে সবাই অবাক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একদমই আশ্চর্য হচ্ছি না।
আসলে সামি হল সেই জোরে বোলার যাকে মাঠের মধ্যে আপনি খুব বেশি হাঁকপাক করতে দেখবেন না। কিন্তু ওকে কিছুক্ষণ দেখার পরেই নিজের অজান্তেই বলে বসবেন, “বাঃ, ছেলেটা ভাল বল করে তো!”
উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রথম যে বার ডালহৌসি ক্লাবে খেলতে এল তখন সে ভাবে সামিকে চিনতাম না। কিন্তু পরের মরসুমে টাউন ক্লাবে সই করে ময়দানে নিজের জাত চেনানোর পালা শুরু সামির। প্রথম বার একটা ক্লাব ম্যাচে ওকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম এ ছেলের দম আছে। জোর আছে কলিজায়।
কেমন সেই জোর? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই।
তিন বছর আগে সামির প্রথম রঞ্জি ম্যাচ। প্রতিপক্ষ অসম। প্রথম দিন খেলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে সামির জন্ডিস ধরা পড়ল। আমরা সবাই চিন্তায়। কোচ থেকে ফিজিও সবাই।
সামি কিন্তু আগাগোড়া বলে গেল, “ফিকর মত করো।” মাঠে নেমে বাইশ ওভার টানা বল করল। তিনটে উইকেট নিল। এক মুহূর্তের জন্যও ওকে ক্লান্ত বোধ করতে দেখিনি।
তার পরের ম্যাচে আর খেলতে পারেনি অসুস্থতার জন্য। ফিরে এসে সল্টলেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে নেমেই ফের চমক এবার পাঁচ উইকেট নিয়েছিল ‘আমরোহা এক্সপ্রেস’। আর তার পর যত দিন গিয়েছে ধীরে ধীরে নিজের পারফরম্যান্সকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে ও।
সামির ক্রিকেটটা ঝলমলে হওয়ার পিছনে দুটো ব্যাপার কাজ করেছে। এক, নাইটদের টিমে ওয়াসিম আক্রমকে বোলিং কোচ হিসাবে পাওয়া এবং তাঁর মন জিতে নেওয়া। দুই, ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তিন টেস্টে ১৩ উইকেট। এই দুটো ঘটনার পরেই সামিকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।
পারফর্ম তো করছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘আমি পারবই’ আত্মবিশ্বাসটা। নেটে ধোনি, রায়না, শিখর ধবন, রোহিতদের বল করে তা আরও বাড়িয়ে নিয়েছে।
ছবি: উৎপল সরকার।
এখন যেমন লম্বা সুইং করাচ্ছে শুরুর দিকে ওর হাতে অতটা সুইং ছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম, ওয়াসিম আক্রম। আক্রমকে পাওয়ার পর একটা ‘ইউ টার্ন’ নিয়েছে সামি। আগে ডেলিভারির সময় ‘রিস্ট পজিশন’ ঠিক থাকত না। বল ছাড়তে গিয়ে ছোটখাটো ভুলচুক করে বসত। ওয়াসিম শুধু যে সেটাই শুধরে দিয়েছেন তা নয়, তুণে ভরে দিয়েছেন ইয়র্কার, স্লোয়ার, সুইং-এর বিষথলি। চার বছর আগের সামির সঙ্গে এখনকার সামির আসমান-জমিন ফারাক।
ওর সঙ্গে গল্প করতে গিয়েই জেনেছি নাইট রাইডার্স শিবিরে বোলিং কোচ ওয়াসিম আক্রম ইয়র্কারের জন্য নেটে সামির প্রাণপাত করা অনুশীলন দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার পরেই সামিকে পিচে ছোট ছোট বোতল রেখে সে গুলোকে লক্ষ করে বল ফেলার অনুশীলন করিয়েছিলেন নিজের হাতে। সেখান থেকেই ইয়র্কারটা ওর ঝুলিতে ঢুকে গিয়েছে। জাতীয় দলে নিয়মিত জায়গা করে নিতে ভুবনেশ্বর কুমার, বিনয় কুমার, উমেশ যাদবদের সঙ্গে এই ব্যাপারগুলোই সামিকে এগিয়ে রাখবে।
আরও একটা কথা। জানেন কি টেলএন্ডারে নেমে ঠান্ডা মাথায় সামির ধামাকা ব্যাটিংয়ের হাত! এটাও ওর কেরিয়ারে একটা পজিটিভ ফ্যাক্টর। স্লগ ওভারের জেনুইন পিঞ্চ হিটার। ক্লাব আর বাংলার হয়ে বহু ম্যাচে ব্যাট হাতে ম্যাচ জিতিয়েছে সামি।
এ রকম একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। গত মরসুমের জোনাল ওয়ানডে। অসম ইডেনে খুব কম রানে আউট হয়ে গেল। আমাদের ব্যাটসম্যানরাও ক্রিজে নেমে ফিরে আসছিল একের পর এক। একমাত্র মনোজ একটা দিক ধরে রেখেছিল।
সামি তখন ড্রেসিংরুমের বারান্দায় আমার পাশে বসে। মিটিমিটি হাসছে। ওর নামার সময় আসতেই উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো একবার চেষ্টা করে দেখি।”
মাঠে নেমে খেলল মোটে পাঁচটা বল। তার মধ্যে দুটো চার। দুটো ছয়। ম্যাচ জিতে গেল বাংলা। সামি কিন্তু উচ্ছ্বাসে গা না ভাসিয়ে সেই ট্রেডমার্ক হাসি মুখে ঝুলিয়ে ফিরে এল ড্রেসিংরুমে। ব্যাটটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “হো গয়া...।”
এ রকমই ঠান্ডা মাথার ক্রিকেটার ও। এখনও মাটিতে পা। তফাত এটাই। আগে বাসে-ট্রামে করে প্র্যাকটিসে আসত। এখন গাড়ি করে আসে। ব্যস্।
চুপচাপ। কম কথার মানুষ। আর কিছুতেই বাংলা বলতে চায় না। বোঝে সবই। বলতে বললেই বলে, “আরে ম্যায় সমঝ গয়া...।” মাঠের বাইরে এ রকমই মজাদার চরিত্র। আত্মভোলা। শশার মতো ঠান্ডা মাথা। আর কাবাব বলতে পাগল!
ওর অবসর মানে ফেসবুক, ইন্টারনেটে হুমড়ি খেয়ে বসে থাকা। প্রেম? নাহ্, এ নিয়ে একটা শব্দ খরচ করে না। জানতে চাইলে অদ্ভুত সারল্য ভরা হাসিমুখে সরে যায় সামনে থেকে। সেই সামিই কিন্তু মাঠে নামলে বদলে যায়। জেতার জন্য মরিয়া। নাছোড়।
ওর প্রিয় অধিনায়ক ধোনি। আমাদের অনেকবার বলেছে, মাঠে বল হাতে বেকায়দায় পড়লেই ধোনি ভাই কী ভাবে ওকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছে।
জাতীয় দলে ওর আরও এক ফেভারিট ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। কোহলি সম্পর্কে বলতে গেলে সামি একটা কথা প্রায়ই বলে, “ড্রেসিংরুমে বিরাট কখনও রিল্যাক্সড হয় না। সব সময় ম্যাচ নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে।”
সামি আবার তার ঠিক উলটো। সব সময় রিল্যাক্সড। একটা ‘করছি করব ভাব’। এটাই এই মুহূর্তে ওর স্বভাবে সবার আগে ছেঁটে ফেলার জায়গা। উন্নতি করতে হবে ফিটনেসেও। টুকটাক কিছু শুধরে নিতে পারলে সামি কিন্তু লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। ওকে দেখে এই মুহূর্তে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়...’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.