মুখোমুখি...
এ দেশের গানতন্ত্র ছবিতন্ত্র আমায় ব্যবহারই করল না

পত্রিকা: ইদানীং খুব বলেন, এই বৈষ্ণবঘাটা বাইলেনের বাড়িটাই আপনার দেশ...
সুমন: হ্যাঁ, আমার দেশ, মহাদেশ সব কিছু। এটা আমার মায়ের ঘর। কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। টিভি দেখি না ছ’মাস! তবে আমার কিছু নবীন বন্ধু আছেন, জরুরি খবরগুলো ঠিক পেয়ে যাই! ওই যেমন সোনা খোঁড়ার খবরটা...

পত্রিকা: এখানে গান রেকর্ডিংয়ে অসুবিধে হয় না?
সুমন: অ্যালবাম-ট্যালবাম রেকর্ড করতে রাত্তিরটাই ভাল। ধরো ১২টা নাগাদ নাইটগার্ডরা হুইস্ল দিতে আরম্ভ করেন। পাড়াটা সাড়ে ১০টা থেকে শান্ত হতে থাকে। আমাকে ওই এক ঘণ্টায় রেকর্ড করতে হয়। ৬৩তে, নন্দীগ্রাম, প্রতিরোধ--- অ্যালবামগুলো ওই ভাবেই...নন্দীগ্রামের কিছুটা গড়িয়াহাটের একটা ভাড়া বাড়িতে...বাকিটা এখানেই। একাধিক ফিল্মের কাজও হয়েছে পাশের ঘরে...

পত্রিকা: এই কায়দাটা তো আপনি আমেরিকাতেই রপ্ত করেছিলেন আশির দশকে। ’৮৯ তে কলকাতায় ফিরেও তিন বছর বাড়ি-বন্দি হয়ে গান রেকর্ডিং চলছিল...
সুমন: হ্যাঁ, হ্যাঁ...ভালই হল কথাগুলো তুললে! লোকে জানতেই চায় না, ধারণাই নেই একজন মিউজিশিয়ানকে কী করতে হয়... আমি হাইব্রিড মিউজিক করেছি। তোমাকে চাই-তে ৩৪টা ট্র্যাক ছিল। সব হার্ডওয়্যার সিকোয়েন্সারে প্রোগ্রাম করা মিউজিক। আমি নিজে ট্যাক্সিভাড়া করে মেশিনসমেত গিয়ে রেকর্ডিং সেরে এলাম। আমার স্বরচিত গানের অ্যালবামগুলোয় মিউজিশিয়ানদের জন্য কোম্পানির খরচ হয়নি বললেই চলে। ছোটদের নিয়ে একসাথে বাঁচবই-এর পুরো ইনস্ট্রুমেন্টেশন আমার করা। বোধহয় আমার সেরা কাজ...

পত্রিকা: এখন বাড়িতে এই ভাবে কাজ করাটা উপভোগ করেন?
সুমন: গোটা কাজটাই ডেস্কটপ থেকে ল্যাপটপে নিয়ে এসেছি। আর উঠে-উঠে পারি না। বাজনার উপাদানগুলো আর একটা কম্পিউটারে রাখা। এইটুকুনি ডিজিটাল মাল্টিট্র্যাক রেকর্ডারে কাজ করি। ছোট্ট কিবোর্ড দিয়ে ট্রিগার করছি, বাজনাগুলো বাজিয়ে নিচ্ছি। গিটার ট্র্যাকে গিটার। আর গলাটা নেওয়ার সময়ে তক্কে তক্কে থাকতে হয়। হঠাৎ কেউ চেঁচিয়ে উঠতেই পারে! রেকর্ড করে এডিট করে নিই।

পত্রিকা: উঠতে অসুবিধে হয় বলছিলেন...
সুমন: ২০১১-য় আমার দু’টো সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কে অক্সিজেন ছিল না। তার পরে নিউমোনিয়া! অপূরণীয় ক্ষতি...মারা যাওয়ারই কথা। কোনও অদ্ভুত কারণে এখনও বেঁচে আছি! আমার নার্ভাস সিস্টেম, মাস্কুলার সিস্টেম, ব্রেন সিভিয়ারলি ড্যামেজ্ড। দশ পা হাঁটতে পারি না।
করেছি সন্ধান একা একা কত

পত্রিকা: ফেসবুকে দেখলাম পিঁপড়ের হাঁটাচলার ছবি তুলে পোস্ট করেছেন। জ্ঞানমঞ্চে আপনার ১৪ নভেম্বরের অনুষ্ঠানের প্রি-অ্যাম্ব্ল...
সুমন: হ্যাঁ এই যাত্রাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। আজকের ভারতবর্ষে খেয়ালের মধ্যে এই যাত্রাটা হারিয়ে গিয়েছে। শুধু কালোয়াতি। অ্যাথেলেটিক ডেকাথলনের মতো হয়ে গিয়েছে। আমারই শুনতে ভাল্লাগে না। তা আমার সন্তান, নাতিপুতিদের কাঁহাতক ভাল্লাগবে। আমি কী শুনব! আমির খান সাহেব ও বড়ে গোলাম আলি সাহেবকে শোনার পরে আর শুনবটা কী! নতুন করে মেঘনাদ-বধ কাব্য লেখার চেষ্টার কি মানে হয়? সম্ভব নয়। আঙ্গিকটাই সব! আঙ্গিকটাতেই জোর দিতে হবে।

পত্রিকা: কালীপদ দাশমশাইয়ের কাছে আপনার অল্পবয়সের খেয়াল-চর্চার কথা লিখেছেন। বন্দিশের কথা নিয়ে অস্বস্তির দিকগুলো, বাংলা খেয়ালের কথাও যে আপনার পোষাচ্ছিল না...
সুমন: আমি শুনেছি, অল ইন্ডিয়া রেডিও বাংলা ভাষার খেয়ালকে স্বীকার করেননি বলে আচার্য তারাপদ চক্রবর্তী একটি বড় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। দেখো হিন্দির ছাঁইয়া, মাইয়া আমার পোষাচ্ছিল না, আবার দখিনা পবন, বাদল রাত-টাতও নয়। আমি তো রাগের একটা রূপ প্রতিষ্ঠা করছি, বিস্তার করছি, রাস্তা খুঁজছি। তাতে ভাষাতে কী আসে-যায়! ভাষা যদি না-ই থাকে শুধু সরগম, তাতে ঠেকাচ্ছে কে? কিন্তু কেন এমন একটা বন্দিশ থাকতে হবে যেটা ভীষণ সাবেকি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সাবেকিয়ানার মোহ।

পত্রিকা: বাংলাদেশ সীমান্তে রক্ষীদের গুলিতে ফেলানি খাতুনের মৃত্যু নিয়ে সদ্য গান করে আপনার ওয়েবসাইটে দিয়েছেন। ফেলানির কথা কী ভাবে উঠে আসবে খেয়ালে?
সুমন: দেখো, এটা একটা উপস্থাপনা! জনসম্মোহিনী রাগ! যাতে আমি গানটা গাইব। এই গানের যা মেজাজ, কথা তার সঙ্গে রাগটা খাপ খায়। তার পরে সরাসরি ফেলানির প্রসঙ্গ আসবে। তার খুলে দাও তার! আমির খান সাহেবের একটা গান ছিল, পার্টিকুলার একটি রাগে গেয়েছেন, অনেক মাথা খুঁড়েছি ভেবে পাইনি। সে-দিন দেখি ইন্টারনেটে একজন অ্যাপ্রোচ করেছেন, আমির খানি কোষ বলে। গানটা হল, পার করো গুণ ...(গেয়ে) আমি প্রথমে গানটির মুখটা পাল্টে তিনতাল ছিল একতালে গাইলাম, পার করো কাঁটাতার। আর জনসম্মোহিনী রাগে বিলম্বিত একতালে গাইব এ পারে দেশ, ও পারে দেশ মাঝখানে কাঁটাতার / এ পাশে দেশ, ও পাশে দেশ কাঁটায় কাঁটায় একাকার। অনুষ্ঠানের একটি অংশ, কাঁটাতারের গান! তবে শুধু কথাই বিষয়বস্তু বলে ভাবা ঠিক নয়। আমির খানি কোষ যে রাগটি সেটাও তো বিষয়বস্তু এবং ফর্ম।

পত্রিকা: কিছু-কিছু পাঠও মিশতে পারে...
সুমন: অবশ্যই। মেজাজ অনুযায়ী! একটা ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এই যাত্রায়! এটা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোনও শিল্পীর সঙ্গে লড়াই নয়! ওই যে টুকরো করে কাছি আমি ডুবতে রাজি আছি...আমাদের শিল্পের ক্ষেত্রেও কাছি যদি কয়েকবার কাটতে না-হয়...দেখিই না, ধ্যাড়ালে ধ্যাড়াব। চেষ্টা করে একবার দেখাই যাক না!

এই তো ভালো আবার শুরু নতুন করে

পত্রিকা: আপনার ওয়েবসাইটটা হয়ে কিন্তু বেশ লাভ হয়েছে। কলামন্দিরের অনুষ্ঠানের স্মরণীয় টুকরো থেকে সুকুমার রায়কে নিয়ে নতুন লিরিক কবীরসুমন অনলাইনের সুবাদে পাচ্ছি।
সুমন: ‘আমি কি তোমার সেই পেঁচা নই, তবে কেন গান দিলে / এনে দাও তাকে গাইব তোমাকে পেঁচিতে পেঁচাতে মিলে’!— সুকুমার রায়কে ভেবে লেখা। এটায় সুর করতে বসেছিলাম। আমার এক নবীন বন্ধু বারণ করল, বলল, সুর দিলে নরম হয়ে যাবে! সলিল চৌধুরীকে ‘অবনী বাড়ি আছ’ শুনিয়েছিলাম। উনি দু’তিনবার শুনলেন, না রে সুমন এটা থেকে সুর বেরিয়ে আসছে। এটায় সুর দিতে নেই। ভয়ঙ্কর জায়গা এটা, গাইব তোমাকে পেঁচিতে পেঁচাতে মিলে। এটাই সুর!

পত্রিকা: ক-ত ইন্টারেস্টিং কাজ তখন জানতে পারিনি। সূর্যকন্যা বলে একটা ছবির গান, এই তো ভালো আবার শুরু নতুন করে...
সুমন: ছবিতে ওটা মা-মেয়ের দৃশ্য ছিল। শ্রীরাধা, স্বাগতালক্ষ্মীর কণ্ঠ। (একটু থেমে) আমায় তো কাজেই লাগাল না কেউ। আমায় ব্যবহার করল না এই দেশটা। গানতন্ত্র, ছবিতন্ত্র আমায় ব্যবহার করল না।

পত্রিকা: এই তো সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জাতিস্মর...
সুমন: ছবিটার হয়ে ওঠায় আমার জাতিস্মর গানটির ভূমিকা আছে। তাছাড়া, কবিয়ালদের লেখার ওপরে ওই সুর, করতটা কে! খুব আনন্দ পেয়েছি! আমার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই একটা অপেরা বানাতে ইচ্ছে করে। ধুত...ছবিতে তো আমায় ব্যবহারই করা হল না।

পত্রিকা: কেন হল না বলে মনে করেন?
সুমন: কে জানে! রাজনীতি, মাওবাদী-নকশাল তকমা একটা কারণ হতে পারে! ঈর্ষা আর একটা কারণ। এ অনেকগুলো বিয়ে করেছে, তাতেও ঈর্ষা। আমারও ইচ্ছে ছিল, পারিনি!

ক’টা বিয়ে, ক’টা প্রেম কবীর সুমন বিচারে-বিশ্লেষণে বাঙালির মন

পত্রিকা: এখানে একটা কথা বলি, আপনার গানের উপাদান হিসেবে শুধু আমির খান বা জার্মানির উল্ফ বিয়ারম্যান কেন আসবেন? কবীর সুমন চর্চা সিরিয়াসলি করা হলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেন বাদ থাকবে?
সুমন: একটা পাল্টা উদাহরণ দিই। রবীন্দ্রনাথ অনেক প্রেমের গান লিখেছিলেন। নিশ্চয়ই অনেক নারীসঙ্গ করেছেন। না-করে থাকলে সেটা ওঁর ব্যাপার। (হাসি) কোন মহিলার জন্য তিনি ‘তুমি রবে নীরবে’ লিখেছিলেন, এই ভাবনাটা বৃথা! এটা আমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না। গানটা কুইন ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে লেখা না অমুক মহিলাকে নিয়ে তাতে কী আসে-যায়! ওটা একটা স্পার্ক! কোনও ব্যক্তি কখনও গান, উপন্যাস বা প্রবন্ধ হন না। তবে আমার প্রেমজীবন বা কামজীবন থেকে তুমি যা জানতে পার, তা হল লোকটা বহুগামী, লোকটা পরোয়া করে না, ঝুঁকি নিতে জানে! এই লোকটা কাউকে জোর করেনি তাহলে ধর্ষণের মামলা হত। দেখো এই লোকটা উওম্যানাইজার ঠিকই, কিন্তু এতগুলো মহিলাও তাহলে সুমনাইজার। সুমন বিবাহিত, এদেরও ৯৯ % বিবাহিত। আমি কিন্তু সমাজের একটা ভাইব্র্যান্ট জায়গা দেখতে পাচ্ছি। যার একটা দিক হয়তো গানে প্রস্ফুটিত, একটা জীবনচর্যায়, কোনওটা হয়তো খিচুড়ি রান্নায়। বাট দ্যাট ওন্ট কাস্ট প্রপার লাইট অন এনি পার্টিকুলার ক্রিয়েশন।

পত্রিকা: তবু একটা সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে জানার জন্য তাঁর জীবনের অনেক দিকই তো গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ কেমন জমিদার ছিলেন, প্রজাদের সাজা-টাজা দিতেন কি না, এটা জানারও দরকার থাকতে পারে।
সুমন: তাহলে মহিলাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করো না! আমার সঙ্গে যিনি বা যাঁরা থাকলেন, তাঁরাই লিখুন না! এটা তুমি খোঁজ করতে গেলে হবে না, কিন্তু তাঁরা যদি বই লেখেন, চমৎকার...

পত্রিকা: একটা সুন্দর পার্সপেক্টিভ উঠে আসতে পারে।
সুমন: কিংবা অসুন্দর! কিন্তু ধরো, রবীন্দ্রনাথ কথায় কথায় রাগ করতেন, এমনটা জানা গেলে তা কী করে শ্যামার স্ট্রাকচারটাকে ক্ল্যারিফাই করে? আজ সকাল সাড়ে ন’টায় কেউ আমায় চুমু খেলে তা ‘ভালবাসা শতযুদ্ধেও জেতা যায় না’র আর্টে কী ভাবে আলো ফেলবে?

এখানে সুমন, এখানে সাবিনা

পত্রিকা: সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে আর গান হতে পারে না?
সুমন: সাবিনা আমার গানগুলি কোনও অনুষ্ঠানে গাইতে পারেন না। ওঁর শ্রোতারা ‘সুপ্রভাত বিষণ্ণতা’ শুনতে চান না। আমি মনে করি, সাবিনার উচিত ছিল। তখন একডালিয়ার পুজোয় আলোয় একটা দাড়িওলা লোক গিটার হাতে হাঁটছে। এতটা জনজীবনের ভেতরে ক’জন শিল্পী ঢুকেছেন। আমি কেন ফাংশনে হিমাংশু দত্ত গাইব? আমি কেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে ভজন গাইব? সেটা যাঁরা আমার সন্তানতুল্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ডেসপারেট চেষ্টা। তখন লোকে সুমন ছাড়া কিছু শুনছে না।

পত্রিকা: আরও অনেকেই তো আপনার গান গেয়েছেন।
সুমন: সাবিনার তুলনা নেই। সন্ধ্যাদি ৭০ বছর বয়সে বলছেন, সুমন আমার ডিপার্চার করিয়ে দাও। আর সন্ধ্যা মুখার্জি থাকতে চাই না। হৈমন্তীও (শুক্লও) অসামান্য গেয়েছিলেন। হংসধ্বনির ওপর...হঠাৎ যেমন আকাশ জুড়ে অকালমেঘে বৃষ্টি আসে, তেমনি এসো...সাবিনা, সন্ধ্যাদি, হৈমন্তী সবাই অ্যালবাম করেছেন। কিন্তু টিভি-তে, ফাংশনে আমার গান কেউ গান না। একমাত্র লোপামুদ্রা (মিত্র) ছাড়া কেউ না। এঁদের আমিও সম্মান করি না। আর করি না!

পত্রিকা: প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়েও লিখেছিলেন, লোকটা নিজেই একটা গান।
সুমন: আফশোস আছে! আমি ওঁর অসম্ভব ভক্ত। ৪০ বছরে এমন নিরীক্ষামনস্ক সুরকার আসেননি। তিনি বলেছিলেন, আমি শোম্যান চট্টোপাধ্যায়। আমি ঠিকই শুনেছি। আর প্লিজ আমার নামের সঙ্গে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত শুনলে গা গিনঘিন করে। ওরা আমার ধারে-কাছে নেই। আমি ভারতের বব ডিলানও নই। আমি হলাম আমি! আরে, রবীন্দ্রনাথ না-শুনলে তোমাকে চাই পারতাম না!

ভরসা থাকুক

পত্রিকা: আর কোনও শিল্পীর কথা বলবেন?
সুমন: কালীপুজোর দিন মনে হচ্ছিল, মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল, কে গাইবে? নজরুল ইসলামের কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা ওই আলোর নাচন কে গাইবে। খানিকটা শ্রীকান্ত (আচার্য) পারবে। ওরও তো বয়স হচ্ছে। শ্রীকান্ত অন্তত গেয়ে দেবে। আর একজনও নেই।

পত্রিকা: মেয়েদের মধ্যে?
সুমন: শ্রেয়া ঘোষালকে আমার ভাল্লাগে না! এরা সবাই এক। সবই প্রেমের গান, সবই বিরহ, সাধারণ দুঃখ! ওকে যদি আজকে চিত্তরঞ্জন স্বদেশে প্রাণমন, ত্যজিলেন জীবন (গেয়ে) গাইতে হত। ইন্ডাস্ট্রি একটা সাম্য এনে দিয়েছে। এই রকম হও। টিন-এজে আটকে সবাই। মৌসুমী ভৌমিক যদি গানটা শিখতেন! আউটস্ট্যান্ডিং গলা! একটা পরম প্রাপ্তি হত।

পত্রিকা: আর আপনার গান গাইবার মতো কেউ...
সুমন: আমি তাও ভাবতে পারি, গৌতম ঘোষ পেটকাটি চাঁদিয়াল গাইছেন। ওঁদের কণ্ঠী বলে ছোট করা হয়। কিন্তু ওঁরা দম রাখেন। কোনও ন্যাকামো নেই। গিটার হাতে ছড়ানো নেই। মাথা ঝাঁকানো নেই। কিশোরকুমারের দুখী মন মেরা গাইতে না-পারলে জগুবাবুর বাজারের ব্যবসায়ী সমিতি মেরে বার করে দেবে!

পত্রিকা: নতুনদের মধ্যে...
সুমন: নতুনকে ভয় পেত পুরনোপন্থীরা। কিন্তু এখন নতুনরাই সব থেকে ডোসাইল, সার্ভাইল। তাদের মিডিয়াকে দরকার। রেওয়াজকে দরকার নেই। তাদের ফ্ল্যাট দরকার, গাড়ি দরকার। ভাল গানটা বিষয় নয়। সবাই সব জানে। সব পারে! আমি হলাম পেরেক, হয়তো হবে ফেরেক। আমি এ বার যাব মিরিক, ফিরিক ফিরিক ফিরিক। ব্যস, একটা গান হয়ে গেল।

দেখো জান ভালবাসা, প্রবীণের প্রলাপে ঘনায়


পত্রিকা: আপনার নিজের গলায় বয়সের দাগ নিয়েও তো বলেন...
সুমন: ৬৫ বছরে ছেলেদের ভারী গলার কিছু সমস্যা থাকবে। সরগম করতে আমার আওয়াজ ঠিক আছে। কষ্ট করি বন্ধু! সংগ্রাম ছিল! গল্প হলেও সত্যি-র সেই দাদুকে মনে আছে! (হাসি) কিন্তু যেটা হয় আরোহণের তানটা নষ্ট হয়ে যায়। তলাটাতে...অবরোহণে ততটা নয়। কিন্তু এখন আমার গলা লোকে শুনবে কেন? মেজাজ! কে আমার গান শুনল কি শুনল না, তা ভাবি না বিশ্বাস করো! কিন্তু এখন আমি যেভাবে আমার অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা গাইব, কিংবা আকাশ এখন জানলার ফ্রেমে ভরা বা মামুলি ছোট্ট একটা সুর গাইব...তার যে মেজাজ! তোর বুঝি ভেঙে গেছে মাথানাড়া বুড়ো...এটা আমি এখন যেভাবে গাইতে পারব...

পত্রিকা: সঙ্গীত নিয়ে এখনকার কোনও স্বপ্ন...
সুমন: দু’টি জিনিস আমার দেখতে ইচ্ছে করে। আমি লিখছি, আর নচিকেতা ঘোষ সুর করছেন। ঈশ্বর! আর তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার গান গাইছেন। আমি কল্পনা করতে পারি, তরুণবাবু তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা যা গাইতেন, তা পৃথিবীতে আর কেউ গাইত না।

পত্রিকা: আপনার থেকে ভাল...
সুমন: ধুত...তরুণ, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এরা যেখানে আছেন আমার কোনও অস্তিত্বই নেই। দেখো, আমি অপরের ক্ষমতার নিরিখে নিজের অক্ষমতাটা বিচার করে গিয়েছি। আমি সেরকম গানই নিজের জন্য গেয়েছি, যেগুলো আমি পারি। যে জায়গাটায় আমি অতিক্রম করেছি পূর্বসূরিদের সেটা তাঁরা ছিলেন বলেই। সময়ের অ্যাডভান্টেজ!

পত্রিকা: রবীন্দ্রনাথ যেমন কালিদাসের কাল নিয়ে লিখেছিলেন, তাঁহার কালের স্বাদগন্ধ, আমি তো পাই মৃদুমন্দ / আমার কালের কণামাত্র পাননি মহাকবি...
সুমন: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, আল মাহমুদ রবীন্দ্রনাথকে পেরিয়ে গিয়েছেন, তিনি ছিলেন বলেই। গানে যেখানটায় আমি রবীন্দ্রনাথকে পেরিয়ে গেছি, সেটাও তিনি ছিলেন বলেই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের তো একটা সুমন ছিল না।

(সাক্ষাৎকারের ভেতরের শিরোনামগুলি কবীর সুমনের লিরিক থেকে উদ্ধৃত)
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.