ভিভের দেশকে তিন দিনে উড়িয়ে
দিয়ে সচিন-পরবর্তী যুগের হুঙ্কার
ডেনের সবুজ, মসৃণ মঞ্চ অপেক্ষায় ছিল ক্রিকেট-মহানায়ককে চিরবিদায় জানানোর। অপেক্ষায় ছিল শেষ বারের মতো তাঁর ব্যাটে একটা রাজকীয় ইনিংস দেখার।
কিন্তু ইডেন কি জানত, বিদায়ের করুণ সুর ছাপিয়ে এ ভাবে বেজে উঠবে আগমনীর আনন্দ-স্বরলিপি?
ইডেন কি জানত, তার বাইশ গজে ক্রিকেট-দেবতার সূর্যাস্তের লগ্নে ক্রিকেট-আকাশে ঘটবে জোড়া সূর্যোদয়?
ইডেন কি জানত, বিসর্জন আর বোধন এ ভাবে মিশে যাবে তার ক্রিকেট ঐতিহ্যে?
ইডেন কি জানত, সচিন তেন্ডুলকরের ১৯৯তম টেস্টে লেখা থাকবে অন্য দুটো নাম রোহিত শর্মা আর মহম্মদ সামি?
দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের সময় যখন ভারতীয় ইনিংস সেঞ্চুরির মুখ দেখার আগেই ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়েছে অর্ধেক টিম, শেন শিলিংফোর্ড নামক ক্যারিবিয়ান অফস্পিনারের ভেলকিতে যখন গ্যালারি স্তব্ধ, তখন সবচেয়ে বেপরোয়া জুয়াড়িও বোধহয় বাজি ধরতে পারতেন না যে, মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে ইনিংস আর ৫১ রানে জয় অপেক্ষা করে রয়েছে টিম ইন্ডিয়ার জন্য! শুক্রবারের বিকেল শেষ পর্যন্ত যে অবিশ্বাস্য জয়ের সাক্ষী থাকল, তার পিছনে ওই জোড়া সূর্যোদয়।
অপ্রত্যাশিত ব্যাটিং-বিপর্যয় মেরামত করার কাজটা বৃহস্পতিবার যেখানে ছেড়ে এসেছিলেন রোহিত, এ দিন ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন। টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরির তালিকায় আগের দিনই ঢুকে গিয়েছিলেন। এ দিন নিজের নাম লিখিয়ে রাখলেন আরও কয়েকটা রেকর্ড তালিকায়। যার মধ্যে আছে জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচে দেড়শো পেরনো। সপ্তম উইকেটে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান (২৮০) তোলা। রোহিত যা ফর্মে ছিলেন, তাতে পেরমলের বলে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এলবিডব্লিউ না হলে আরও কুলীন একটা সরণিতে এ দিন তিনি ঢুকে পড়তেন। টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি প্রাপ্তির ক্লাবের ‘মেম্বারশিপ’ পেলেন না রোহিত। কিন্তু তাঁর ১৭৭ রানের ইনিংসটাকে মহাকাব্যিক বললে ভুল হয় না। রোহিতের ছোটবেলার কোচ মাঝে মাঝে বলেন, পরিবর্তিত এই রোহিতের মূলধন হচ্ছে শটের পারফেকশন রেট। তাই ইডেনে রোহিত যে ইনিংসটা খেললেন, সেটাকে বাউন্ডারির গজ-ফিতেয় মাপতে গেলে ভুল হবে। দেখতে হবে একটাও শট তাঁর ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কি না। দেখতে হবে ম্যারাথন ইনিংস খেলতে খেলতে একটাও সুযোগ তিনি দিয়েছেন কি না। দেখতে হবে তাঁর ১৭৭ রানের ইনিংসে একটাও শট ক্রিকেট ম্যানুয়্যালের বাইরে ছিল কি না।
তিনটে প্রশ্নের উত্তর একটাই না।
দুই নায়ক

শুক্রবার ইডেনে। ছবি: উৎপল সরকার।
একটা সময় রোহিত-অশ্বিন জুটি ইডেনে উপস্থিত স্ট্যাটিস্টিশিয়ানদের নোটবুক খুলতে বাধ্য করল। ততক্ষণে সপ্তম উইকেটে ২৮০ উঠে গিয়েছে, অশ্বিন টেস্টে করে ফেলেছেন নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। রেকর্ড-বুক বলছে, ইডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০১ ঐতিহাসিক টেস্টে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের পার্টনারশিপ ৩৭৬। রোহিতরা কি এ বার সেটাও পেরিয়ে যাবেন? সেই সুখের মন্তাজ যদি জনৈক পেরমল নষ্ট করে দিয়ে যান, তা হলে দুপুর-দুপুর আবার সেটা ফিরেও এল।
ফিরে এল বোলার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হাত ধরে। ফিরে এল মহম্মদ সামি নামের এক ক্ষুধার্ত ফাস্ট বোলারের পেস-বিস্ফোরণে।
দ্বিতীয় দফায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচ উইকেট উড়ে গিয়েছে, ঘড়ি বলছে দুপুর আড়াইটে। সিএবি কর্তাদের মুখ থমথমে। প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার ঘরে শুরু দফায়-দফায় বৈঠক। গোলাপ-পাপড়ি বৃষ্টির এ বার কী হবে? সিএবি-র শিডিউলে তো তৃতীয় দিনে সে সবের কোনও বন্দোবস্ত নেই। সামির রিভার্স সুইংয়ের ধ্বংস তখনও শুরু হয়নি, পেয়েছেন সবে দুটো উইকেট। কিন্তু এর পর সামি যা শুরু করলেন, দেখার পর কয়েকটা কথা নিশ্চিন্তে লিখে ফেলা যায়।
জাহির খানের পর স্বপ্নের এই রিভার্স সুইংয়ের খোঁজ কোনও ভারতীয় পেসার দিতে পারেননি। যে পেসে সামি রিভার্স আর কাট করিয়ে ক্যারিবিয়ানদের স্টাম্প একের পর এক ছিটকে দিচ্ছিলেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় “আনপ্লেয়েবল।” আজকের পর কোনও ভারতীয় পেসার হিসেবে অভিষেকে সবচেয়ে বেশি উইকেট প্রাপ্তির তালিকায় সামির নামই সবার উপরে থাকবে। থাকবে দু’ইনিংস মিলিয়ে তাঁর ১১৮ রানে ন’উইকেট। স্পিনার, পেসার ধরলে নরেন্দ্র হিরওয়ানি একে। কিন্তু শুধু পেসারদের দুনিয়ায় সেরার শিরোপা এখন থেকে বাংলার ফাস্ট বোলারের। আজ যাঁর রিভার্স করানোর ঐশ্বরিক ক্ষমতা সময় সময় মনে পড়িয়েছে ইমরান খানকে। আজ যাঁর বোলিং দেখে মনে হয়েছে, ভারতের জার্সিতে খেলছে বোধহয় আক্রম-ওয়াকারদের কোনও যোগ্য উত্তরসূরি। সামি কেমন বল করলেন, সেটা ইডেনে শুক্রবার যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, দেখেছেন। যাঁরা দেখলেন না, তাঁদের জন্য একটা ফ্রেমই যথেষ্ট। সামির অফ-কাটারে গড়াগড়ি খাচ্ছে কটরেলের মিডল স্টাম্প। উত্তরপ্রদেশজাত পেসারকে ঘিরে টিমমেটদের তুমুল হইহট্টগোল। শুধু ড্রেসিংরুমে একা বসে ইশান্ত শর্মা। মুখে একমুঠো মন-খারাপ। অতি কষ্টে যেন হাততালি দিচ্ছেন।
কিন্তু দিল্লি পেসারের দিকে তখন তাকানোর সময় কার আছে?
ইডেনে ততক্ষণে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রবীণের সঙ্গে নবীন-বরণের উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকে যেমন ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাশি-রাশি উপহারে, মহম্মদ সামির দিকে তেমন এগিয়ে আসছে একের পর এক অভিনন্দনের হাত। রোহিত শর্মার হাতে সৌরভ তুলে দিচ্ছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার।
শুক্রবারের বিকেল এর পর থেকে বাংলা ক্রিকেটের ইতিহাস বইয়ের একটা অমূল্য পাতা হয়ে থাকল। যেখানে লেখা রইল, আজ সচিনের বিদায়যাত্রার সূচনা। লেখা রইল, সচিন-যুগ শেষে কারা ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী ভরসার হাত। আর লেখা রইল এক অমোঘ সত্য।
জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। ক্রিকেট তো আরওই নয়!

প্রথম ইনিংস
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
গেইল ক বিজয় বো ভুবনেশ্বর ১৮
পাওয়েল ক ভুবনেশ্বর বো সামি ২৮
ব্রাভো রান আউট ২৩
স্যামুয়েলস বো সামি ৬৫
চন্দ্রপল বো অশ্বিন ৩৬
রামদিন বো সামি ৪
স্যামি ক ভুবনেশ্বর বো ওঝা ১৬
শিলিংফোর্ড এলবিডব্লু সচিন ৫
পারমল ক ও বো অশ্বিন ১৪
বেস্ট ন.আ ১৪
কটারেল বো সামি ০
অতিরিক্ত ১১
মোট ২৩৪।
পতন: ৩৪, ৪৭, ১৩৮, ১৩৮, ১৪৩, ১৭২, ১৯২, ২১১, ২৩৩, ২৩৪।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১৪-৬-৩৩-১, সামি ১৭-২-৭১-৪, অশ্বিন ২১-৯-৫২-২,
ওঝা ২৪-৬-৬২-১, সচিন ২-১-৫-১

ভারত
(আগের দিন ৩৫৪-৬)
রোহিত শর্মা এলবিডব্লিউ বো পেরমল ১৭৭
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ক রামদিন বো বেস্ট ৪২
আর অশ্বিন বো শিলিংফোর্ড ১২৪
ভুবনেশ্বর কুমার ক গেইল বো শিলিংফোর্ড ১২
মহঃ সামি স্টাঃ রামদিন বো পাওয়েল ১
প্রজ্ঞান ওঝা নঃ আঃ ২
অতিরিক্ত ১৬
মোট ৪৫৩।
পতন: ৪২, ৫৭, ৭৯, ৮২, ৮৩, ১৫৬, ৪৩৬, ৪৪৪, ৪৫১, ৪৫৩।
বোলিং: বেস্ট ১৭-০-৭১-১, কটারেল ১৮-৩-৭২-১, শিলিংফোর্ড ৫৫-৯-১৬৭-৬,
পেরমল ২৩.৪-২-৬৭-২, স্যামি ১২-১-৫২-০, স্যামুয়েলস ৪-০-১২-০

দ্বিতীয় ইনিংস
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ক্রিস গেইল ক কোহলি বো ভুবনেশ্বর কুমার ৩৩
কিয়েরন পাওয়েল এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৩৬
ডারেন ব্রাভো ক রোহিত বো অশ্বিন ৩৭
মার্লন স্যামুয়েলস এলবিডব্লিউ সামি ৪
রামদিন ক মুরলী বিজয় বো সামি ১
শিবনারায়ণ চন্দ্রপল নঃ আঃ ৩১
ডারেন স্যামি বো সামি ৮
শিলিংফোর্ড বো সামি ০
পেরমল রান আউট ০
টিনো বেস্ট ক ওঝা বো অশ্বিন ৩
শেলডন কটারেল বো সামি ৫
অতিরিক্ত ১০
মোট ১৬৮।
পতন: ৩৩, ১০১, ১১০, ১২০, ১২৫, ১৫২, ১৫২, ১৫২, ১৫৯, ১৬৮।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৬-১-২০-১, সামি ১৩.১-০-৪৭-৫, অশ্বিন ১৯-২-৪৬-৩,
ওঝা ১৩-৩-২৭-০, সচিন ৩-০-১৮-০




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.