|
|
|
|
কলকাতা যেন আমাকে এ রকমই ভালবেসে যায়
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
টেস্ট ক্রিকেটজীবনে চূড়ান্ত তালাচাবি পড়ার আরও ন’দিন।
কিন্তু কলকাতার সঙ্গে বাইশ বছরের ক্রিকেট-প্রেমকাহিনি শুক্রবারই আচমকা শেষ হয়ে গেল সচিন তেন্ডুলকরের!
রাতে কলকাতা ছাড়ার আগে কিছুটা বিমর্ষই দেখাল সচিনকে। একটা টেস্ট ম্যাচ তিন দিনে জিতে উঠে যে তৃপ্তি থাকা উচিত, সেই আলোটা মুখে আদৌ নেই। যতই বলুন না কেন, “জীবনে তো এক দিন না এক দিন এই মুহূর্তটা আসতই। এসেছে যখন, মন খারাপ করে লাভ নেই।”
শুক্রবার ভারত জুড়ে নতুন ফিল্ম রিলিজের দিন। নতুন আশা-নতুন আশঙ্কা-নতুন সম্ভাবনা-ছবির সাফল্য ঘিরে লেবার পেনের দিন। কে জানত সেই শুক্রবারেই এত অতর্কিত ভাবে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তেন্ডুলকর আর ইডেনের এত বছরের সুপারহিট সম্পর্ক? তা-ও এত অনাড়ম্বর ভাবে! কারও মন ভরবে না। যে মাপের সংবর্ধনা হবে ঠিক ছিল, সেটা করা যাবে না। এমনকী সবাই যা ভেবেছিল, সচিন একটা চূড়ান্ত ল্যাপ দেবেন মাঠ জুড়ে, সেটাও তো ঘটল না। সবাই যখন অপেক্ষা করে রয়েছে, এ বার সচিন আবার বার হবেন পুরস্কারগুলো ড্রেসিংরুমে রেখে, তখন আসলে তিনি হোটেল রওনা হয়ে গেলেন। টিমমেটরা পড়ে থাকলেন। তিনি একা বেরিয়ে গেলেন। রাতেও বাকিরা থেকে গেলেন শহরে। সচিন একা ধরলেন মুম্বই ফ্লাইট। হোটেল ছাড়ার আগে নিজের ঘরে বসে সময় দিলেন একমাত্র আনন্দবাজারকে। লোকে তাঁর গোটা ইডেন দৌড়নোটা কেন পেল না জানতে চাওয়ায় বললেন, “এমন একটা কেওস ওই সময়টা হয়ে গেল যে, ভাবনায় থাকলেও করা গেল না। মনে হল, আর থাক।”
আর মিনিট দশেকের ভেতর এয়ারপোর্ট রওনা হবেন। কিন্তু ওই শেষ সময়েও ঘরের বাইরে চিরকালীন সেই ভিড়। |
সেই জুটি
খেলোয়াড় হিসেবে ইডেনে শেষ দিনে সচিনকে পাগড়ি পরিয়ে
আলিঙ্গন করলেন সৌরভ। দর্শক মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার। ছবি: উৎপল সরকার। |
নাকি শুক্রবার সন্ধেতে আরও বেশি? এত কড়া নিরাপত্তা এ বারও টিম হোটেলে যে, ক্রিকেট-জনতার ওপরে যাওয়ার কোনও সুযোগই নেই। চূড়ান্ত ছানবিন সর্বত্র। প্রেসের গাড়ি তো ঢুকতেই দেওয়া হয়নি এই ক’দিন হোটেলের অন্দরমহলে। তবু ৪১৭ নম্বর ঘরটার বাইরে এমন গিজগিজে ভিড় কারণ, সেখানে পুলিশ, সিআরপিএফ আর হোটেলের লোকজনই ঠায় দাঁড়িয়ে গত আধ ঘণ্টা। হোটেলের মহাকর্তা বিদায়ী উপহার পাঠিয়েছেন। কিন্তু দেওয়া যাবে কী করে সচিনকে? দরজা তো বন্ধ। শুনলাম প্যাকিং করছেন। সচিনের প্যাকিং করতে এ বার অনেক সময় গেল। দুটো পেল্লায় সাইজের সুটকেস ঠেসেও মাল পুরো ঢোকানো যাচ্ছে না। এত এত উপহার। কী করে সব নিয়ে যাবেন? শুনলাম মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা তাঁকে উপহার দেওয়া ছবিটা সিএবি সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সেটা বাদ দিয়েও তো উপহারের পাহাড়। আর মুম্বইয়ের বাড়িতেও পৌঁছচ্ছে গোটা দেশ থেকে।
সচিন হাসতে হাসতে বলেন, “আমার নতুন বাড়িটা ভেবেছিলাম বড়। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, ছোট মনে হচ্ছে। আমি ভাবছি খুব সবিনয়ে এ বার বলব, কারও মনে আঘাত না দিয়ে যে, প্লিজ আমাকে শুভেচ্ছা দিন, উপহার আর নয়।” কলকাতার এক প্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে এ বার তাঁর চল্লিশতম জন্মদিনে শহরেই আইপিএল ফাইনালের ফাঁকে অনেক সময় কাটিয়েছেন। একসঙ্গে ক্রিকেট খেলেছেন। খেয়েছেন। সে ল্যামিনেশন করে সব ছবি দিয়েছে। সচিন তা অটোগ্রাফ করে দিয়ে গেলেন এত দিনের অঙ্গসংবাহক পিন্টুকে। পিন্টুর তাঁকে জড়িয়ে ধরে চোখে জল আসার উপক্রম। দেখে সচিন নিজে শান্ত করেন, “মন খারাপ করিস না। নতুন ছেলেরা তো থাকল।” একটু দূরে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিকেট কর্তা সমর পাল। কলকাতায় সমরের হেঁশেল থেকেই বরাবর সচিনের ডিনার আসে। বৃহস্পতিবারের মেনু ছিল কাঁকড়া আর চিকেন। ঠিক পাশের ঘরে থাকা কোহলি আর উল্টো দিকের ঘরবাসী শিখর ধবন মেনুতে খুব উৎসাহীও ছিলেন। নিষেধ করেন সচিন নিজে। ড্রেসিংরুমে যেমন নানান ক্রিকেটীয় টিপস দেন জুনিয়রদের। তেমনই এটা খাওয়া সংক্রান্ত, “ম্যাচের মধ্যে কখনও কাঁকড়া খেও না। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই কিন্তু আমি দেখেছি কাঁকড়া অমঙ্গল ডেকে আনে।”
সব সময় এ ভাবে পাশে থাকেন বলেই বিরাট-রোহিতরা শুধু নন, গোটা টিম সচিনকে এত সম্মান করে। আর তাঁকে ‘পাজি’ বলে ডাকে। ভাজ্জি, যুবরাজ আর সহবাগ নাকি বলেছেন, আমরা টিমে নেই তো কী। ওয়াংখেড়ে যাচ্ছি। আর খেলা শেষ হলে স্ট্রেট মাঠে ঢুকে ওকে মাথায় তুলে বাইরে আনব। সচিনকে কাঁধে তুলে মাঠ থেকে বার করব। দেখি কে আটকায়? সচিন বলেন, “আরে আমি তো এটা সে দিন শুনলাম। এরা যা করছে! এই সব যদি সত্যিই শুরু হয়, তখনই বোধহয় বুঝতে পারব যে, অবসর নিয়ে ফেললাম। এখনও কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজে বুঝে উঠতে পারছি না।” কিন্তু তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন না তাঁকে ঘিরে গোটা দেশের আকুতি আর বিষণ্ণতা? দেখলেন না ইডেন কেমন ভাবে ব্যাট করতে যাওয়ার সময় তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিল?
এইখানেই অবাক করে দিলেন সচিন। বললেন, “ফিল্ডিং করার সময় গ্যালারিতে মুখোশ দেখলাম। চারপাশে আমার কাটআউট আর ছবি দেখছি। কিন্তু সবার দাঁড়িয়ে ওঠা খেয়ালই করিনি।” এর পর নিজেই ব্যাখ্যা করেন, “ব্যাট করতে নামার সময় সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা থাকে। তখন আমি একটা জোনে চলে যাই।” কথাটা মর্মান্তিক শোনাল সচিন সাধারণ ভাবে বললেও। “তখন একটা জোনে চলে যাই,” বলার লোকটাই তো বিশ্বক্রিকেট থেকে চলে যাচ্ছে। |
বিদায়বেলায় |
কলকাতায় ক্রিকেট সফরের শেষ সন্ধ্যা।
হোটেলের ঘরে একাকী শহর ছাড়ার প্রস্তুতি। |
খুদে সচিন-ভক্তের সঙ্গে। যার নামও তার আইডলের নামানুসারে। |
ঘরের বাইরে নিরাপত্তাকর্মীদের অটোগ্রাফের আবদার মেটাচ্ছেন। |
ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য |
ইডেন যে দিন তাঁকে মহাসংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল,
সে দিনের না হওয়া খেলার টিকিটে স্বাক্ষর রেখে গেলেন সচিন। |
|
টেস্ট ঘিরে সিএবি-র সচিন-সংবর্ধনাজনিত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কী, শাহরুখ খানের যে চতুর্থ দিন নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে খেলা দেখতে আসার পরিকল্পনা ছিল, তার কিছুই জানেন না সচিন। মনে হল এটাও জানেন না যে তাঁর এক সময়ের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রায়ান লারা আজ, শনিবার কলকাতা নেমে আবিষ্কার করবেন, যে জন্য এলেন সেই কারণটা তো নেই-ই। পাখিও মুম্বইয়ে উড়ে গিয়েছে। নাইজেল লং কোন হোটেলে উঠেছেন সেটা যে লোকে আনন্দবাজারে ফোন করে জানতে চাইছে বলায় একচোট হাসেন সচিন। তার চেয়েও বিস্ফারিত শুনে যে, জগমোহন ডালমিয়া আম্পায়ারের ওপর উত্তেজিত হয়ে পড়ে বলেছেন, ‘সচিনের তো ডব্লিউ জি গ্রেসের মতো করা উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল, লোকে তোমার কুৎসিত আম্পায়ারিং দেখতে আসেনি। এরা এসেছে আমার ব্যাটিং দেখতে।’ সচিন এটাও জানেন না শুধু বাংলাতেই যে হাজার হাজার লোক বিলাপ করছে— আর কী! সচিন নেই, ক্রিকেট দেখব না।
সব শেষ!
সচিন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, “কলকাতা প্রথম বছর থেকেই আমাকে এমন ভালবাসা দিয়েছে যে, আমি বলতে পারব না এ বারে আরও বেশি ভালবাসো। হ্যাঁ, এ বার হয়তো সব কিছু আরও বড় করে হয়েছে কিন্তু আন্তরিকতাটা প্রতি বার একই রকম। এই উত্তাপটা আমার জীবনের সম্পদ। বিদায়বেলায় আপনার কাগজের মাধ্যমে শুধু বলি, আমাকে এ রকমই ভালবেসে যাবেন। মাঠে হয়তো আর থাকলাম না। মাঠের বাইরে তো আছি।” ইডেনে টেস্ট-ওয়ান ডে মিলে বাইশ বছরে ছাব্বিশ ম্যাচ খেলেছেন। মোট রান ১৩৬৮। ওয়ান ডে গড় ৪৯.৬০। টেস্ট গড় ৪৫.৮৯। যথেষ্ট ভাল। কিন্তু সচিনের বোধহয় কলকাতাকে মনে থাকবে তার হৃদয়ের উত্তাপের জন্য। “প্রতি বার এয়ারপোর্টে নামা থেকেই সব কিছু আলাদা।”
কিন্তু এই মুহূর্তে গোটা ভারতের ক্রিকেট-বিষণ্ণতার যা সেনসেক্স, তাতে তো সর্বত্র তাঁর ‘কলকাতা’ অনুভব করা উচিত। তাঁর কি সেটা মনে হচ্ছে না? সচিন জবাব দিলেন, “ডিসিশনটা নেওয়ার পর বাইরের জগতে প্রায় যাইনি। তাই হয়তো মুম্বইয়ে এত বুঝিনি। তবে এক বন্ধুর বাড়ি এখানে আসার আগে গিয়েছিলাম। সাংবাদিক আর বহু দিনের বন্ধু পাপ্পু সনস্গিরি-র বাড়ি। ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় দেখি গোটা বিল্ডিং বেরিয়ে এসে দু’দিকে দাঁড়িয়ে ব্যাট ওপরে ধরে আমাকে গার্ড অব অনার দিল। রোমাঞ্চিত লেগেছিল। ভাবতেই পারিনি।”
কিন্তু এই যে ইডেনে রান পেলেন না আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমন এক দিনের কম সময়ে ধড়াধ্ধড় পড়ে গেল তাঁর তো যুগ্ম দুঃখ হওয়া উচিত। যে এরা এত খারাপ টিম, আমি নির্ঘাৎ মুম্বইয়েও দু’ইনিংস পাব না। যা করার তার জন্য হাতে থাকল ওয়াংখেড়ের একটাই ইনিংস! ভারতীয় দলের ম্যানেজার সতীশ তখন ঘরে ঢুকে এসেছেন। সচিন তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, পাশের টেবিলের কাঠ ছুঁয়ে বলেন, “এ সব একদম বলবেন না। মনে রাখবেন ক্রিকেট ইজ এ ফানি গেম।” ওই একটা মুহূর্ত দেখাল কেমন ব্যাকুল ভাবে ওয়াংখেড়েতে চ্যাম্পিয়নের ইগো দু’টো সুযোগ খুঁজছে। কেবল একটা ইনিংস যে বড় অনিশ্চিত, সে তো দেখাই গেল!
মুম্বই টেস্ট শেষ করে উঠে কী পরিকল্পনা? কোথাও চলে যাবেন? “অবশ্যই,” বলেন সচিন। “আমি কিছু দিনের জন্য সব কিছু থেকে পালাতে চাই। একটু সময় আমার দরকার।” আবার যেন মনে হল দুনিয়া কাঁপানো চ্যাম্পিয়ন মুখে যা-ই বলুন, অবসরের সম্ভাব্য করুণ ভাইরাস তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করেছে। আর তো কখনও ক্রিকেট খেলতে কোনও শহরে যাবেন না। শুক্রবার রাতের কলকাতা-মুম্বই ফ্লাইটটাই সচিন তেন্ডুলকরের জীবনের শেষ ক্রিকেট-ফ্লাইট হয়ে থাকল।
ইডেনের শেষ ল্যাপটা না হওয়ার চেয়ে সেটা যে অনেক বড় যন্ত্রণা! |
|
|
|
|
|