শিল্পায়নের জন্য জেলায় ঘটা করে শিল্পতালুক প্রকল্পের শিলান্যাস হয়েছে। কিন্তু দেখা মিলছে না শিল্পোদ্যোগীদের। সেই পরিস্থিতিতে প্রতিটি জেলায় বণিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। চলতি মাস থেকেই শুরু হবে এই সম্মেলন। তদারকির জন্য ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতরের পদস্থ অফিসারেরা জেলায় যাবেন কলকাতা থেকে।
গত ২৯ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গ সফরে যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তার মধ্যে ছিল জলপাইগুড়ির আমবাড়ি-ফালাকাটা তালুক। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী জানান, প্রস্তাবিত তালুকগুলো করা গেলে অন্তত ৩৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাম আমলের ওই প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছিল ২০০৯-এর ২১ ডিসেম্বর। ২০১০-এর ২৭ জানুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ এগোয়নি।
রাজ্যে পালাবদলের পরে নতুন করে ওই প্রকল্পের পরিকল্পনা হয়। নিয়োগ করা হয় নতুন ঠিকাদার। গত ৩০ অগস্ট তালুকের ১,৭৭২ কাঠা জমি বণ্টনের জন্য আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। বলা হয়, প্রতিটি শিল্প-ইউনিটের জন্য ১০ একরের মতো জমি বরাদ্দ হবে। কিন্তু এক মাসের সময়সীমায় আবেদন জমা পড়ে গুটিকয়েক। তার পরে আরও দেড় মাস কেটে গিয়েছে। আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়ছে না।
তালুক রূপায়ণের দায়িত্ব রাজ্যের ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের। নিগমের চেয়ারম্যান সব্যসাচী বাগচি বলেন, “তালুকটির পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রাথমিক সব কাজ হয়ে গিয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে কয়েক দফা কথা হয়েছে বিদ্যুৎ সংবহন নিগমের সঙ্গে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।”
তা হলে শিল্পোদ্যোগীরা এই সব শিল্প তালুকে জমি নিতে আসছেন না কেন? ‘বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর ডিরেক্টর জেনারেল প্রিয়দর্শন রায় বলেন, “শুনতে পাচ্ছি, সাধারণ ভাবে বিভিন্ন শিল্পতালুকে সরকারের তরফে জমির দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে। কেবল রাস্তা, জল বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা হলেই হবে না। সার্বিক পরিকাঠামোগত সুবিধা পেলে তবেই শিল্পোদ্যোগীরা জমি নিতে আগ্রহী হবেন।”
ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান সব্যসাচী বাগচি বলেন, “আমাদের পরিচালনমণ্ডলী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখেই জমির দাম নির্ধারণ করেন। বাজারদরের থেকে বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে না।” তবে এই রকম পরিস্থিতিতে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতর দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের প্রস্তাবিত তালুক থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান বলেন, “ওই জমিটা জাতীয় সড়ক থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে। আশেপাশে রাস্তা নেই। এ রকম জায়গায় পরিকাঠামো উন্নয়ন করতে প্রচুর খরচ হবে। তা ছাড়া, শিল্পোদ্যোগীর অভাবের সমস্যা তো আছেই। প্রকল্পটি থেকে আমরা তাই সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
শিল্পোদ্যোগীর অভাবের কথা স্বীকার করেছেন দফতরের সচিব রাজীব সিংহও। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী শিলান্যাস করার পরে আমি নিজে দু’দিন বাড়তি থেকে গিয়েছিলাম প্রস্তাবিত শিল্পতালুকের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। চলতি মাস থেকে কেবল জলপাইগুড়ি নয়, সব জেলাতেই উদ্যোগপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসব।” তিনি জানান, প্রতিটি জেলায় মাসের একটি নির্দিষ্ট তারিখে বৈঠক হবে। শিলিগুড়ি, কোচবিহারে তাঁর নিজেরই যাওয়ার কথা রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ২০১৫-র ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রস্তাবিত তালুকগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। এ কারণে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি। কিন্তু ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতর সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত অন্তত পাঁচটি তালুকের জমি এখনও নিগমের হাতে আসেনি। এগুলোর মধ্যে আছে বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় ২১.২৮ একর, বর্ধমানের শক্তিগড়ে (দ্বিতীয় পর্যায়) ১৫ একর, হুগলির মাহেশে ৫২ একর, জলপাইগুড়ির ডাবগ্রামে ৭ একর, পশ্চিম মেদিনীপুরের খাসজঙ্গলে ২৫.২৯ একর। জমি মেলেনি খড়্গপুর ও বেলুড়ের সম্মিলিত প্রকল্পেরও।
কেন এই হাল? রাজীববাবু বলেন, “প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্পের জমি বিভিন্ন দফতর ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের মাধ্যমে নিগমকে দেবে। তার জন্য কিছু সময় লাগছে। প্রশাসনিক কাজ শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই জমিগুলো পাওয়া যাবে।” তাঁর সংযোজন, “এই মুহূর্তে জমি হাতে থাকলেও লাভ হত না। কারণ, এই মুহূর্তে প্রকল্প রূপায়ণের টাকা নেই।”
তা হলে টাকা আসবে কোথা থেকে? নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কী ভাবে প্রকল্পগুলো শেষ হবে? সচিবের জবাব, “সহজ শর্তে গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিল অর্থাৎ আরআইডিএফ-এর ১০০ কোটি টাকার ঋণ পাওয়া যাবে।” এ কারণে অর্থ দফতরের সঙ্গে জাতীয় গ্রামোন্নয়ন ব্যাঙ্কের (নাবার্ড) কথা হয়েছে। সচিবের আশা, আগামী অর্থবর্ষে প্রস্তাবিত প্রতিটি প্রকল্পের কাজেই গতি আসবে। |