এক সময় এই হাসপাতালকে সামনে রেখে প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসান পরিকল্পনা করেছিলেন কল্যাণীকে স্বাস্থ্যনগরী করার। এক সময় হৃদরোগ সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যায় গোটা রাজ্যের একমাত্র নির্ভরতা ছিল কল্যাণীর গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল। কিন্তু সে সব এখন অতীত। এখন এখানে এসে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় হৃদরোগীর। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে প্রতিদিনই রোগীদের কলকাতায় রেফার করে দেওয়া হয়।
বেশিদিনের নয়, কালীপুজোর রাতের ঘটনা। কল্যাণী থানার সাব ইন্সপেক্টর সুজিত ভৌমিককে ভর্তি করানো হয়েছিল এখানে। সুজিতবাবু হৃদরোগী ছিলেন। তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হওয়ার কথা ছিল, এমনটাই জানতেন তাঁর সহকর্মীরা। তাঁকে ভর্তির সময় হাসপাতালে কোনও কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। কারণ কার্ডিওথোরাসিক এই হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্ট মাত্র একজন। বাধ্যতামূলক হলেও চিকিৎসকদের জন্য নির্দিষ্ট আবাসনে তাঁরা থাকেন না। তাই কার্ডিওলজিস্টের দেখা মেলেনি। কর্তব্যরত মেডিক্যাল অফিসার চেষ্টা করেও সেদিন বাঁচাতে পারেননি সুজিতবাবুকে।
হাসপাতালে চিকিৎসার এমন দৈন্যদশা নিয়ে চিকিৎসকদের একাংশ আঙুল তুলেছেন সরকারি নিয়ম নীতির বেড়াজালে আটকে থাকা বর্তমান পরিকাঠামোর দিকে। বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই যাঁদের, কিংবা কলকাতার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নয় উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের যে হৃদরোগীদের, তাঁদের জন্য ১৯৬৭ সালে তৈরি হয়েছিল এই হাসপাতাল। ১৯৯৪-এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা হাসপাতালের জমিতে নুরুল হাসান পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের নামাঙ্কিত ফলক উন্মোচন করেন। গাঁধী হাসপাতালকে ঢেলে সাজাতে প্রচুর দামি যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছিল সেসময়। তবে এখন আর সে সবের হদিস জানা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
তিনতলা হাসপাতালের দোতলায় কার্ডিওলজি, কোণের একটি ঘর শেষ কবে খোলা হয়েছিল জানা নেই কারও। একসময় গোটা কার্ডিওলজি বিভাগটি দাঁড়িয়ে থাকত এই ঘরের উপর ভর করে। ঘরের ভিতরে পড়ে থাকা অচল সিনে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি যন্ত্রে মোটা হয়ে ধুলে জমে পাঁচ-সাত বছর আগেই। নতুন করে যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে গয়ংগচ্ছ ভাব দেখিয়েছিল আগের বাম সরকার। বর্তমান সরকার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে, খুব শিগগিরই নতুন যন্ত্র আসবে।
তবে যন্ত্র এলেই যে সমস্যা মিটবে এমনটা বলা যাচ্ছে না। কারণ, সিনে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি যন্ত্র চালানোর জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। যদি আগের যন্ত্রটি চালু থাকত তা হলে হয়তো সুজিতবাবুর প্রাণ বাঁচানো যেত বলে চিকিৎসকদের অভিমত। সুজিতবাবুর মতো হৃদরোগীরা এই হাসপাতালে প্রতিদিন আসেন। তাঁদের কেউ রেফার করার পর প্রাণ হাতে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছন। কারও হয়তো রাস্তাতেই মৃত্যু হয়। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালের দু’টি অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে একটি বন্ধ। যেটি চালু আছে, তাতে সদ্য কেনা একটি ওটি ল্যাম্প ছাড়া বাকি সবই মান্ধাতা আমলের। ইসিজি মেশিনও তুলনায় কম।
হাসপাতালে শুধু যে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি আছে এই তা নয়, সার্জেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসাবে পদটি থাকলেও হাসপাতালের বর্তমান সুপার সার্জেন নন। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সুপারের পদের পাশাপাশি কল্যাণী জওহরলাল নেহরু হাসপাতালেরও দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ফলে এখানে পুরো সময় তিনি দিতে পারেন না। হাসপাতালের প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলান অ্যাকাউন্ট অফিসার অধীর সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘সিনে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি যন্ত্রটি এলে কার্ডিওলজি বিভাগটি ঠিকমতো চালু করা যায়। যন্ত্র চেয়ে বার দশেক স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছি। কিছুই হয়নি। তবে জরুরি বিভাগটা সম্প্রতি সাজানো হয়েছে। সিসি টিভি বসেছে। বিশ্রামাগার হয়েছে রোগীর আত্মীয়দের জন্য। শুক্রবার এখানে ন্যায্য মূল্যের ওষুধ দোকানের উদ্বোধন করবেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। মন্ত্রীর কাছে আবারও আর্জি জানাব ওই যন্ত্রের জন্য।’’
গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালকে কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় ইউনিট হিসাবে ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে। সেটা হলেই ওই হাসপাতাল পূর্বাবস্থায় ফিরবে এমনটাই জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, ‘‘মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশনের মাধ্যমে অবিলম্বে একটি সিনে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি যন্ত্র গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালকে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। মেডিক্যাল কলেজের আওতায় এনে এই হাসপাতালকে ঢেলে সাজাব।”
মন্ত্রীর এই আশ্বাস কতদিনে বাস্তবায়িত হয় সেটাই দেখার। |