গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জন সেরে ঘরে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল একই পরিবারের তিন সদস্য-সহ চার জনের। জখমের সংখ্যা ৩৭। তাদের মধ্যে গুরুতর জখম ১৬। তার মধ্যে বেশ কয়েক জন শিশু। বুধবার রাত সওয়া ১২টা নাগাদ ওই দুর্ঘটনা ঘটে আলিপুরের বেলভেডিয়ার রোডে জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনে। ঘটনার পর থেকে চালক পলাতক। বুধবার রাতের ওই দুর্ঘটনায় চেতলা থানার পুলিশের একাংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কী করে পুলিশের নজর এড়িয়ে বুধবার রাতে মাটালি বাগান এলাকার পুজো উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট সময়সীমার (৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার, কালী পুজোর বিসর্জনের শেষ দিন ছিল) পরেও এত লোকজন নিয়ে ট্রাকে চেপে বাবুঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন করতে গেলেন? কেন তাঁদের বিসর্জনের শোভাযাত্রা পুলিশ ওই এলাকাতেই আটকে দিল না? তা ছাড়া তাঁদের পুজোর অনুমতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে পুলিশকর্তাদের মধ্যেই। চেতলা থানার বক্তব্য, পুজোটি পারিবারিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে পুজো পারিবারিক, তার জন্য পুলিশের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল কেন? সেই অনুমতি মেলেনি, সে কথাও উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। অনুমতি না মিললেও পুজোটি একটি ছোট গলির ভিতরে হয়। এত সব জেনেও পুলিশ নির্দিষ্ট সময়ে বিসর্জন দেওয়া নিশ্চিত করেনি কেন, উঠছে সে প্রশ্নও। |
নির্দিষ্ট সময়ের পরে বিসর্জন করতে যাওয়া হল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেননি পুজোর উদ্যোক্তারা।
যদিও লালবাজারের কর্তাদের চেতলা থানা জানিয়েছে, ওই পুজো বাড়ির পুজো হিসেবেই চিহ্নিত। থানার বক্তব্য, চেতলা থানার অধীন নথিভুক্ত কালীপুজোর সংখ্যা ৩৮টি। কিন্তু পুজো হয় দ্বিগুণেরও বেশি। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় পুজোর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে, এ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঠিক পরেই থানার অফিসারেরা ওই পুজো উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাস্তা আটকে শোভাযাত্রা করা এবং সরকারি নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করেন। এ ক্ষেত্রে চেতলা থানার ওসি-র ভূমিকাও খতিয়ে দেখছেন লালবাজারের কর্তারা। কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মুরলীধর বলেন, “পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যে সব প্রশ্ন উঠেছে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাতে চেতলার পিয়ারীমোহন রোডের মাটালি বাগান এলাকার জনা পঞ্চাশেক বাসিন্দা ছোট একটি ট্রাকে চেপে কালী প্রতিমা বিসর্জন শেষে ফিরছিলেন। ট্রাকচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আলিপুরে জাতীয় গ্রন্থাগারের পাঁচিলে সজোরে ধাক্কা মারেন। দুর্ঘটনার জেরে দুমড়ে-মুচড়ে যায় ট্রাকটি। ঘটনাস্থলেই এক জন মারা যান। আলিপুর থানার পুলিশ আহতদের ওই রাতেই এসএসকেএম ও শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আরও তিন জনের মৃত্যু হয়।
পুলিশ জানায়, মৃতদের নাম রাজু দলুই (৫৮), সবিতা দলুই (৪৫), পুতুল দলুই (২২) এবং দেবনাথ পারুই (২৬)। তাঁদের বাড়ি মাটালি বাগানে। |
কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল? প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, বিসর্জনের জন্য স্থানীয় এক ট্রাকচালকের উপর জোরজবরদস্তি করে গাড়িতে ওঠেন জনা পঞ্চাশেক পুরুষ ও মহিলা। কয়েক জন তরুণী তাঁদের শিশুসন্তানদের নিয়েও গাড়িতে ওঠেন। চালক অত জনকে গাড়িতে উঠতে নিষেধ করলে উদ্যোক্তারা তাঁকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। পুলিশের অভিযোগ, বিসর্জন শেষে চালককে জোর করে নেশা করান পুজোর উদ্যোক্তারা। বিসর্জনে অংশগ্রহণকারী একাধিক পুরুষ-মহিলা বুধবার সন্ধ্যা থেকে নেশা করেছিলেন। বিসর্জনের পরে চালক গাড়ি চালাতে একেবারেই রাজি হননি বলে পুলিশ জেনেছে। চালককে সেই সময় আরও এক দফা মারধর করে জোর করে গাড়ি চালাতে বলা হয়। পুলিশ জানায়, আহতদের এসএসকেএমে ভর্তি করানোর পরে রাতেই চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখান আহতদের আত্মীয়েরা। বৃহস্পতিবার সকালে আরও এক জনের মৃত্যুর পরে তাঁরা হরিশ মুখার্জি রোডে নেমে তুমুল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। হাসপাতালে কয়েক জন চিকিৎসককে ধাক্কাধাকি করেন তাঁরা। প্রতিবাদে চিকিৎসকদের একাংশ দুপুর থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন। হাসপাতালে যান রাজ্যের পুরমন্ত্রী তথা এলাকার বিধায়ক ফিরহাদ হাকিম। হাজির হন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র ও দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুব্রত বক্সী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এ দিন সন্ধ্যায় ওই চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন। এ নিয়ে আজ, শুক্রবার এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের নিয়ে বৈঠক করবেন পরিবহণ মন্ত্রী। হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ফিরহাদ হাকিম এ দিন বলেন, “চিকিৎসকেরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন আহতদের সুস্থ করে তোলার। তাঁদের আত্মীয়দের উচিত চিকিৎসকদের সাহায্য করা।” এ দিন মাটালি বাগান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দোকানপাট এবং ১৭ নম্বর রুটের বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। রাতেই চেতলা নিয়ে আসা হয় চার জনের মৃতদেহ। পরে এলাকার কয়েক হাজার লোক মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে যান। সঙ্গে ছিলেন এলাকার বিধায়ক ববি হাকিম।
|