যৌনকর্মীদের জন্য বৃদ্ধাবাস রাজ্যের
খন আর কেউ ফিরেও তাকায় না!
এক দিন ছিল, যখন বাতিস্তম্ভের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সন্ধ্যা-রেখাদের চোখের ইশারায় কুঠুরিতে ঢুকে পড়তেন অচেনা বাবু। এ ভাবে কেটেছে রাতের পর রাত। আঁধার ঘনালেই সস্তার ঝলমলে শাড়ি আর রুজ-লিপস্টিক মেখে ‘খদ্দের’ ধরতে রাস্তায় নেমে পড়া। শরীর বেচে রোজগারের টাকায় দিন গুজরান।
সেই শরীর আর নেই। তাই বাবুরাও নেই। কিন্তু যত দিন প্রাণ আছে, তত দিন খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে তো!
সোনাগাছির সন্ধ্যাদি-রেখাদিরা সে চেষ্টা চালিয়েও পেরে উঠছেন না জেনে রাজ্য সরকার ওঁদের দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই ঘোষণা করেছিলেন। সেই মতো সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধা যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের কাজে নেমে পড়েছে প্রশাসন। টালিগঞ্জে চারু মার্কেটের কাছে আবাসন দফতরের একটি পুরনো দোতলা বাড়ি সংস্কার করে তাঁদের জন্য ‘হোম’ তৈরি হচ্ছে।
প্রকল্পের নামও ঠিক করেছেন মমতা। মুক্তির আলো। ১০০ জন বৃ্দ্ধা যৌনকর্মীকে নিয়ে তা পথ চলা শুরু করবে। প্রশাসন সূত্রের খবর, কলকাতার উত্তর-দক্ষিণে একাধিক যৌনপল্লিতে সমীক্ষা চালিয়ে ইতিমধ্যে ৭৮৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাঁরা বৃদ্ধা, অশক্ত, প্রায় কপর্দকহীন, এবং হোমে থাকতে ইচ্ছুক। পুজোর আগে উত্তর কলকাতায় সমীক্ষাপর্ব তদারক করেছেন বিধায়ক শশী পাঁজা। তাঁর দাবি, ওই সব বৃদ্ধাকে আজীবন দেখভালের দায়িত্ব সরকারই নেবে। রাজ্যের সমাজকল্যাণ-সচিব রোশনী সেন জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে এক বছরের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে অর্থ দফতর। “কলকাতায় যৌনকর্মীর সংখ্যা বেশি বলে উদ্যোগটি শুরু হচ্ছে এখানে। পরে একে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য।” বলছেন তিনি।
এবং ক্রমে হোমের সংখ্যা বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সকলের থাকার ব্যবস্থা করা হবে বলেও সচিব জানিয়েছেন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে চিহ্নিত ৭৮৯ জনের মধ্যে একশো জনকে বাছা হবে কী ভাবে?
বিধায়ক শশীদেবীর ব্যাখ্যা, “যাঁদের আর্থিক ও শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ, প্রথম সুযোগ তাঁরাই পাবেন। প্রাথমিক ভাবে এমনটাই ভাবা হয়েছে। তবে অনেকে লটারির মাধ্যমে বাছাইয়ের পক্ষেও মত দিয়েছেন।” সমাজকল্যাণের এক কর্তার বক্তব্য, প্রকল্পটিতে আরও দু’টি বিষয় যুক্ত হবে। কেউ যৌনপেশা ছাড়তে চাইলে তাঁর জন্য বিকল্প উপার্জনের সংস্থান, পাশাপাশি তাঁদের সন্তানদের জন্য হোমের ব্যবস্থা করা।
আপাতত অবশ্য বৃদ্ধা যৌনকর্মীদের হোমে আশ্রয়দানেই সীমিত থাকছে মুক্তির আলো। যাঁদের স্বার্থে এ আয়োজন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী?
সরকারি পরিকল্পনার কথা শুনে ওঁরা বেজায় খুশি। সন্ধ্যাদি এক গাল হেসে বললেন, “মমতা নিজে তো মেয়ে। তাই আমাদের যন্ত্রণা বুঝতে পারল। ওকে আশীর্বাদ করছি।” রেখাদির কথায়, “আমাদের জীবনে সবই অন্ধকার। বয়স থাকতে অনেকে ভাল রোজগার করে। পরে তা বারো ভূতে লুটেপুটে খায়। মাথা গোঁজার আশ্রয় আর দু’বেলা খাবার পেলে অন্তত পথে পড়ে থেকে কুকুরের মতো মরতে হয় না।”
আশি পেরোনো সন্ধ্যাদির এই মুহূর্তে ঠিকানা বৌবাজারের হাড়কাটা গলির রোয়াক। বয়সের ভারে, রোগেভোগে কুঁজো হয়ে গিয়েছেন। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা। সম্বল বলতে একটা পুঁটলি, কয়েকটা ছেঁড়া শাড়ি। ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পরে স্বামীর হাত ধরে ঢাকার মীরপুর থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাসে। সময়টা দেশভাগের কিছু আগে। “তার পরে কলকাতায় মারামারি-কাটাকাটি শুরু হল। স্বামী ট্রাম কোম্পানিতে কাজ করত। এক দিন বেরিয়ে আর ফিরল না!” স্মৃতিচারণ করেন বৃদ্ধা। অসহায় যুবতীকে ‘কাজ’ দেওয়ার নামে সেই যে যৌনপল্লিতে বেচে দিল এক পড়শি, তখন থেকে ওটাই ওঁর স্বর্গ-নরক সব কিছু। বলেন, “গোড়ায় মানতে পারিনি। পরে ভালই খদ্দের জুটত।”
টানা ছেষট্টি বছর নিষিদ্ধপল্লির অলি-গলিতে কাটানো সন্ধ্যা এখন ভগ্নস্বাস্থ্য, কপর্দকহীন। রাস্তার ভিখিরি। বছর পঁচাত্তরের রেখাদির অবস্থাও তথৈবচ। সোনাগাছির গলিতে মাথা গোঁজার একটা ঘর থাকলেও জানেন না, ক’দিন ভাড়া জোটাতে পারবেন। ষাট বছর আগে হাবড়ার কিশোরীকে পাড়ারই এক জেঠিমা বেচে দিয়েছিলেন সোনাগাছির মাসির কাছে। সেই থেকে টানা জীবন-যুদ্ধ। গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে তিন ভাইকে বড় করেছেন। ভাইরা অবশ্য দিদির খোঁজ রাখেন না। অসুস্থ বৃদ্ধার দিনের বেশিটা কাটে বিছানায় পড়ে থেকে। পাড়ার দোকান থেকে দু’টো রুটি বা একটা ওষুধ কিনে আনার লোকও সব সময় পান না।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হিংয়ের কচুরি’ গল্প অবলম্বনে সত্তরের দশকে তৈরি হয়েছিল ‘নিশিপদ্ম।’ সেখানে দেখা গিয়েছিল, যৌনকর্মী পুষ্প পাশের গৃহস্থবাড়ির ছোট্ট ছেলে ভুতোকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসেন। বহু বছর বাদে সহায়-সম্বলহীন, অসুস্থ পুষ্পকে মেসবাড়ির ঝিয়ের কাজ থেকে ছাড়িয়ে মায়ের মর্যাদা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যায় ভুতো। শেষ বয়সে মায়ের মর্যাদা না-পেলেও মুক্তির আলোয় রেখাদি-সন্ধ্যাদিরা অন্তত বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেতে পারেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.