গড়িয়ায় গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণে মাছের পুর ভরা আলুকে সরিয়ে ঢুকে পড়ছে পটলের দোলমা। কলেজ স্ট্রিটের স্কুলের গেটে চেনা আলুকাবলিওয়ালার দেখা নেই, স্কুলপড়ুয়ারা মনমরা। ক্লাস সেভেনের অভিষেক রায় হতাশ সুরে বলছে, “আলুকাবলিতে টিফিনের পয়সা খানিকটা বাঁচত! এখন চাউমিনই খেতে হচ্ছে!”
আলু-সঙ্কটে গত কয়েক দিনে বাঙালির জীবনটা এমনই আলুনি। কলকাতার বিরিয়ানির তুরুপের তাস বলতেও সেই আলুই। বিরিয়ানি-চেনগুলির জন্য রোজ ৭০০ কেজি আলু লাগে শহরে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিরিয়ানির দাম বাড়াটা প্রায় অনিবার্য। বিরিয়ানি ইন্ডাস্ট্রির হোমরাচোমরারা এখন তাই ঘন ঘন আলু ‘সাপ্লায়ার’দের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। সিরাজ এবং নিউ আলিয়া হোটেলের দুই কর্মকর্তাই বললেন, “চড়া দামের আলু ম্যানেজ করে বার করতে প্রাণ ওষ্ঠাগত।” বিরিয়ানি চেন আলিবাবা বুধবার বিরিয়ানি থেকে আলু নির্বাসনের স্পর্ধা দেখিয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার কর্ণধার অনিরুদ্ধ গুহরায় কবুল করলেন, “বিক্রিবাট্টা জোর ধাক্কা খেয়েছে। আর দু-এক দিন সময় দিন, যে ভাবেই হোক আলুকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনবই।”
একই অবস্থা ফুচকা-ব্যবসায়ীদেরও। কলেজ স্ট্রিটের মহেন্দ্র সিংহ বা রামমন্দিরের সঞ্জয় সিংহ ফুচকার সামান্য দাম বাড়িয়েছেন। ১০ টাকায় সাতটার দর ছয়ে নেমেছে। কিংবা ১০ টাকায় পাঁচটার দর চারে। বিবেকানন্দ পার্কের দিলীপকুমার সাউ ক’দিন আগে মুম্বইয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সাফ কথা, “আলু হল কলকাতার ফুচকার জান। মটর দিলে সেটা তো পানিপুরীই হয়ে গেল!” জোড়া গির্জার আলুকাবলিওয়ালা যোগিন্দর সাউয়ের রোজকার লাভ ২০০-২৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় নেমে এসেছে। ছটে বাচ্চাদের নতুন জামা দিতে পারেননি। যোগিন্দর লজ্জায় মুলুকে যেতে পারছেন না। |
বড়-সড় হোটেল-রেস্তোরাঁও আলুর অভাবে ‘প্ল্যান বি’ ছকে রাখছে। এখন পরিস্থিতি সামলে নিলেও ভজহরি মান্না-য় আলুঝিঙে পোস্তর বদলে শুধু ঝিঙে পোস্ত বা ঝিরঝিরে আলুভাজার বদলে কুমনোফুল-পাটপাতার বড়া বাঙালি কতটা গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে মাথা খোঁড়া হচ্ছে। মাংসের ঝোলের আলুরই বা কী বিকল্প হতে পারে! বাঙালি খানার একটি রেস্তোরাঁর কর্তা ক্ষুব্ধ, “এ-ও ক্রিকেট হচ্ছে। ইডেনে লাল বা সাদা বলে খেলা হয়, আলু বা পেঁয়াজ নিয়েও খেলা চলছে। কৃত্রিম সঙ্কট।”
কে সি দাশের দোকানে রাধাবল্লভীর সঙ্গে একবেলা ডাল, একবেলা আলুর তরকারি চলত। আলুর তরকারি এখন নির্বাসনে। এমনকী, আলুর পুরের শিঙাড়াও নির্বাসন দিয়ে তাঁরা চিজ-কর্নের ভিন্ধারার শিঙাড়াই টিকিয়ে রেখেছেন। ভবানীপুরের বলরাম মল্লিকের কর্ণধার সুদীপ মল্লিক বললেন, “এক সঙ্গে চার-পাঁচটা বাজারে ওত পেতে আলু জোগাড় করতে হচ্ছে।” শ্যামবাজারের মোড়ে কচুরি-তরকারি জন্য খ্যাত হরিদাস মোদকও লড়াই দিচ্ছে।
কিন্তু পাড়ার অপেক্ষাকৃত ছোট দোকানগুলোর অত জোর কোথায়? বেলগাছিয়ার জলধর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে শিঙাড়া, আলুর তরকারি দু’টোই বন্ধ। চেতলার ‘দেশের খাবার’ দু’দিন শিঙাড়া বন্ধ রেখেছিল। এ দিন বিকেলে অবশ্য নিরুপায় হয়েই তারা ফের শিঙাড়া ভাজতে নেমেছে। বাগবাজার মোড়ের কচুরি বিক্রেতা রাধেশ্যাম সাউ বলছেন, “কচুরির দাম তিন থেকে চার টাকা করেছি। তা-ও শুক্রবার থেকে আলু জুটবে কি না ঠিক নেই।” ঢাকুরিয়া দক্ষিণাপন বাজারে জিতেন্দ্র গুপ্তর স্বীকরোক্তি, “আলুর স্টক আগে থেকে তোলা ছিল, তাই ম্যানেজ করছি। এমন চললে বিক্রি বন্ধ রাখা ছাড়া গতি নেই।” সভয়ে দিন গুনছেন কেটারার কর্তারা। তাঁদেরই এক জন প্রবীর কুমার পাল। বলেই ফেললেন, “বিয়ের সিজ্ন শুরু হতে এখনও দিন দশেক দেরি, এটাই রক্ষে। নইলে হাহাকার পড়ে যেত।” |