হেঁটে চলেছেন শীর্ণ এক মহিলা। মাথায় পরমান্নের পাত্র। শান্ত দৃষ্টি দূরে প্রার্থনায় মগ্ন থাকা সৌম্যদীপ্ত এক যুবকের দিকে।
সুজাতা এবং সিদ্ধার্থকে নিয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যের এই বিখ্যাত গল্পটিকে ভাস্কর্যে রূপ দিয়েছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ। বিশ্বভারতীর কলাভবনে গেলে খোলা মাঠে দু’টি ভাস্কর্যের দেখা মেলে। বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে উন্মুক্ত এই সব ভাস্কর্যের অনেকগুলিই প্রায় নষ্ট হতে বসেছে। উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের নির্দেশে বিখ্যাত শিল্পীদের ওই সমস্ত শিল্পকর্ম এ বার সংরক্ষণে উদ্যোগী হল বিশ্বভারতী। সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে আজ, শুক্রবার শান্তিনিকেতনে পৌঁছচ্ছেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) একটি বিশেষজ্ঞ দল।
কলাভবনের অধ্যক্ষ শিশির সাহানা বলেন, “বিশিষ্ট শিল্পীদের তৈরি ওই শিল্পকর্মগুলি অটুট রাখাটাই আমাদের কাছে আসল চ্যালেঞ্জ। তার জন্য যথাযথ পদ্ধতি মেনে সংস্কার করা হবে। কলাভবনের বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, শিল্পীদের নিয়ে এএসআই-এর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব।”
বিশ্বভারতী সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই কৃষি অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রের সামনে থাকা ‘ভিস্তিওয়ালা’ নামে পরিচিত ভাস্কর্যটি সংরক্ষিত হয়েছে। ১৯৫৮-৫৯ নাগাদ রামকিঙ্করের তত্ত্বাবধানে কলাভবনের তৎকালীন শিক্ষক সুরেন দে ওই সেটি নির্মাণ করেছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে মাথার একাংশ ভাঙা অবস্থায় ভাস্কর্যটি পড়ে ছিল। সম্প্রতি কৃষি অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে উপাচার্য সেটির সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। বিভাগের দুই শিক্ষককে নিয়ে সেই কাজ শেষ করেছেন ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান সুতনু চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ভিস্তিওয়ালার সংরক্ষণ জরুরি ছিল। উপাচার্য ও কলাভবনের অধ্যক্ষের উদ্যোগেই কাজটি শেষ করা গেল।” |
সংরক্ষণের অপেক্ষায় রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি ভাস্কর্য সুজাতা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |
শুধু ‘ভিস্তিওয়ালা’ বা ‘সুজাতা’ নয়, প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের কাজ হবে অন্য সব শিল্পকর্মেরও। কলাভবন ছাড়াও বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ভাস্কর্য। পাঠভবন দফতর, হিন্দি ভবন, চিনা ভবন ও কলাভবনে থাকা নানা ফ্রেস্কো, ম্যুরাল ও রিলিফ-এর কাজেরও সংরক্ষণ হবে। দ্রুত সংরক্ষণ প্রয়োজন, এমন শিল্পকর্মের তালিকাও তৈরি হয়েছে। কয়েকটি সংরক্ষণের কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছে। ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান বলছেন, “এখানে খোলা মাঠেই নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম গড়ে উঠেছে। সারা বছর তা রোদ-বৃষ্টি-হাওয়ায় পড়ে থাকে। নষ্ট তো হবেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব আদর্শেই শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মগুলি ‘ওপেন স্পেসে’ই রেখেছেন। ফলে সেগুলিকে সরানোও ঠিক কাজ হবে না।”
এই পরিস্থিতিতে ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘কলের বাঁশি’, ‘গৌতম বুদ্ধ’, ‘গাঁধী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ সব শিল্পকর্মগুলি আগের জায়গায় রেখেই সংরক্ষণে উদ্যোগী হচ্ছে বিশ্বভারতী। কলাভবনে দীর্ঘ ৯ বছর অধ্যক্ষের পদ সামলানো শিল্পী সনৎ করও বলেন, “ওই সব শিল্পকর্ম আমাদের জাতীয় সম্পদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, টাকার অভাবে কোনও দিনই ঠিক মতো সংরক্ষণ হয়নি।”
চিত্রকর যোগেন চৌধুরী বলেন, “কোটি কোটি টাকার শিল্পকর্ম রয়েছে বিশ্বভারতীতে। যদিও টাকা দিয়ে সেগুলির প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। সেগুলি সংরক্ষিত হলে দেশ উপকৃত হবে।” |