ছবিতে খোয়াই বাদ দিও না।
অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরার মুখোমুখি শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরির আগে সত্যজিৎ রায়ের কাছে শিল্পীর আবদার ছিল, “তোমার ছবিতে খোয়াই থাকছে তো? খোয়াই বাদ দিও না।” সত্তরের দশকের গোড়ায় শান্তিকেতনের অপসৃয়মাণ সেই খোয়াইয়ের কয়েকটা ঠিকানাও দিয়েছিলেন তিনি, “তালতোড়, প্রান্তিক স্টেশনের দিকটায়। আর আছে চিপ সাহেবের কুটির দিকে।” প্রায়ান্ধ শিল্পীকে নিয়ে তাঁর ‘ইনার আই’ ছবিতে সেই সব লাল কাঁকুড়ে টিলা-পাহাড়ের কিছু নমুনা ধরে রেখেছিলেন সত্যজিৎ।
একচল্লিশ বছর আগে, সে ছবি তৈরির সময়ে তালতোড়, গোয়ালপাড়া, শ্যামবাটী কিংবা কোপাই নদীর কোল ঘেঁষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গিয়েছিল খোয়াই। হারানো সেই খোয়াইয়ের উপরে আড়ে বহরে বেড়ে উঠেছে নব্য শান্তিনিকেতন। শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের (এসএসডিএ) ‘পরিকল্পিত’ নগরায়ণের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘কংক্রিটের জঙ্গল’। হ্যাঁ, খোয়াই-শূন্য হালের শান্তিনিকেতনকে এ ভাবেই দেখছে ইংল্যান্ডের ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইন অ্যান্ড
টাউন প্ল্যানিং’।
শান্তিকেতন-সহ দেশের বেশ কয়েকটি ‘ঐতিহাসিক’ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জনপদকে তাদের পুরনো চেহারা বজায় রেখেই সাজানোর প্রস্তাব দিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছে ওই ব্রিটিশ সংস্থা। কোজিকোড়, বুদ্ধগয়ার সঙ্গে সেই তালিকায় রয়েছে ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ও। ইনস্টিটিউটের পক্ষে জন মেরিডিথ তাই বলছেন, “শান্তিনিকেতনের প্রায় প্রতিশব্দ হয়ে গিয়েছে সেখানকার লাল মাটির খোয়াই। অথচ সেই খোয়াই এখন হারিয়ে গিয়েছে। আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি সেখানকার নগরায়ণও পরিকল্পিত নয়।” কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “ইংল্যান্ডের ওই সংস্থার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের মতামতও নেওয়া হবে।” |
আশ্চর্য সমাপতন! শান্তিনিকেতনের পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শুক্রবার নতুন করে আন্দোলনে নামল স্থানীয় আশ্রমিকদের সংগঠন ‘আমরা সবাই’।
খোয়াই বাঁচানোই তাঁদের মূল দাবি। সঙ্গে রেয়েছে, নগরায়ণের নামে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা বসতির ভিড়ে ‘আশ্রমিক পরিবেশ’ হারানো শান্তিনিকেতনের সংস্কার। সংগঠনের সম্পাদক কিশোর ভট্টাচার্য এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দফতরের
প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সিকে চিঠি দিয়ে তাঁদের দাবি জানিয়েছেন। কাকতালীয় ভাবে, দিল্লি ও কলকাতায় তাঁদের
দাবি দাওয়া পাঠানোর জন্য আশ্রমিকেরা বেছে নিয়েছিলেন যে দিনটিকে, সেই শুক্রবার ছিল ‘বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস’।
কিশোরবাবু বলেন, “শান্তিকেতন যেন এখন আর রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া সেই শিক্ষায়তন নয়। তা যেন কলকাতার স্বচ্ছল মানুষের কান্ট্রি হাউস তৈরির পীঠস্থান। খোয়াই মুছে সেখানে নিজের আস্তানা গড়াই মানুষের লক্ষ্য। খোয়াই, ছায়াছন্ন গাছগাছালি, আশ্রমের শান্তি হারিয়ে নিছক একটা পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠছে শান্তিনিকেতন।”
শিল্পী যোগেন চৌধুরী দীর্ঘ দিন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। তাঁরও উপলব্ধি, “যা হারিয়েছে তা হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যেটুকু রয়েছে তাকে বাঁচানোর মানসিকতাও আর বিশ্বভারতী কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের নেই।” পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আজন্ম শান্তিকেতনের বাসিন্দা সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, “যথেষ্ট নগরায়ণ হয়েছে। আশ্রমিক চরিত্রটুকু বাঁচিয়ে রাখার সময় হয়েছে এ বার।” আর তীব্র আক্ষেপ শিল্পী সেলিম মুন্সির। তিনি বলেন, “খুব কষ্ট হয় শান্তিনিকেতনের এই চেহারা দেখে। আমি আগেও বহু বার আপত্তি তুলেছিলাম। সাড়া মেলেনি। এখনও যদি আমরা সংঘবদ্ধ না হতে পারি, কবে হব!”
এসএসডিএ সূত্রে দাবি, এ ব্যাপারে তাদের হাত-পা যে কার্যত বাঁধা। কেন? এসএসডিএ-র সহকারী পরিকল্পনা আধিকারিক সুবর্ণা পণ্ডিত বলেন, “বিশ্বভারতী নিজস্ব এলাকায় কোনও নির্মাণের ব্যাপারে আমাদের মতামত নেওয়ার প্রশ্ন নেই। তবে তার বাইরে যে নির্দিষ্ট ‘বাফার জোন’ বা শান্তিনিকেতনের সংলগ্ন এলাকা রয়েছে সেখানেও কোনও নির্মাণ করতে হলে আমরা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তবেই অনুমোদন দিয়ে থাকি।” তবে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্তা জানান, শান্তিনিকেতনের বাড়-বৃদ্ধি লাগোয়া ১১টি মৌজায়। যার অধিকাংশই বিভিন্ন পঞ্চায়েতের দখলে। সে ব্যাপারে নজরদারি করবে কে?
ওই সব এলাকাতেও কাঠা প্রতি জমি বিকোচ্ছে চার থেকে সাত লক্ষ টাকায়।
দূর্মল্য এই খোয়াইয়ের বিকিকিনি রুখবে কে? |