ব্যাট হাতে মানুষটা তো হার্ভার্ডেই পড়াল
বিশ্বের সেরা বাণিজ্য-মস্তিষ্কদের সাফল্যের রাস্তা দেখানো হয় সেখানে।
সচিন যেন মাঠে ও মাঠের বাইরে চলমান হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল। লিখছেন মুদার পাথেরিয়া |
পাঠ ১ |
আইএসও স্বীকৃত বলতে বোঝায় কোনও সংস্থার উৎপাদন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা। মানে, পদ্ধতি যদি একই থাকে তা হলে সেই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যা তৈরি হবে, তার গুণগত মানের হেরফের হবে না।
তেন্ডুলকর তখন নেহাতই বাচ্চা ছেলে। টেনিস বল ভিজিয়ে নিয়ে নিজেদের আবাসনের মাঠে বন্ধুদের ডেকে বোলিং করতে বলতেন। সাধারণত ভিজে টেনিস বল ভীষণ দ্রুত স্কিড করে বলে ব্যাটসম্যানরা পেস বোলিং খেলার অভ্যাসে এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে তাই ধরে নেবেন ওই ছোট বয়সেই তেন্ডুলকর বলটা ভিজিয়ে নিতেন, যাতে সেটা মাটিতে পড়ে আরও জোরে ব্যাটে আসে। কিন্তু তেন্ডুলকর ছিলেন শিশু-কৌশলী; বলটা মারার পর সবার আগে ব্যাটটা ঘুরিয়ে ধরে পরীক্ষা করে দেখতেন ভেজা বলের ছাপ ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লেগেছে কি না। যদি দেখতেন বল ব্যাটের ঠিক মাঝখান দিয়ে মারতে পারেননি, তা হলে নিজেকে বলতেন আরও বেশি মন দিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলের উপর চোখ রেখে যাও।
যতই হোক, পদ্ধতিটা যদি ঠিক থাকে, রান আসবেই। |
|
পাঠ ২ |
বাণিজ্যের দুনিয়ায় তারাই সফল যারা অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়ে নতুন করে মেজেঘষে নিতে পারে নিজেদের দক্ষতা।
২০১১ বিশ্বকাপ। প্রথম দিকের কয়েকটা ম্যাচে রান পাননি। তেন্ডুলকর তাই গোড়া থেকে আবার শুরু করলেন। নেটে অদ্ভুত একটা নির্দেশ দিলেন বোলারদের। বললেন, হাফ-পিচ থেকে আমাকে বল ছোড়ো। এর পর দক্ষতা ঝালাই করে নেওয়ার সনাতন পদ্ধতিটা হত সেই বলগুলো ব্যাট দিয়ে মারা। কিন্তু তেন্ডুলকর কাজটা আরও কঠিন করে নিলেন। বোলারের হাত থেকে বলটা বেরোনোর মুহূর্তে একবার দেখে নেওয়ার পর চোখ বন্ধ করে ফেলতে লাগলেন। আর চোখ বুজেই ড্রাইভ করে বলকে কভার থেকে পয়েন্টের মধ্যে যে কোনও জায়গায় পাঠানো অভ্যাস করলেন। ভাবনাটা এই রকম ছিল যে, নেটে যদি চোখ বুজে মারতে পারেন তা হলে ম্যাচে খোলা চোখে ব্যাটে-বলে হবেই। |
পাঠ ৩ |
যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিমুহূর্তে বিভিন্ন দিক থেকে খুঁত খুঁজছে, সেখানে ঝুঁকি এড়ানোই ব্যবসার মূল মন্ত্র
এক দশক আগের কথা। অস্ট্রেলীয়রা এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয় যে তেন্ডুলকরের দুর্বলতা ধরে ফেলা গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অঙ্ক ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে টানা বল করে যাও। তাতে ব্যাট বাড়িয়ে চালাতে গিয়ে কানায় লেগে ক্যাচ উঠবে। অস্ট্রেলীয় বোলারদের রণকৌশল ছিল এই রকম--তেন্ডুলকরকে টানা অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে প্রলোভন দেখিয়ে গেলে দু’টো জিনিসের যে কোনও একটা হবে। হয় লোভে পড়ে খোঁচা মেরে কট বিহাইন্ড বা স্লিপের তালুবন্দি। আর যদি লোভ সংবরণ করেন, তা হলেও রান না পেতে পেতে একটা সময় বিরক্তি থেকে বাজে শট মেরে উইকেট দিয়ে যাবেন। জবাবে সব অঙ্ক ভেস্তে দেন তেন্ডুলকর। নিজের ব্যাটিংয়ের বহুমুখী দিকটা তুলে এনে অবিশ্বাস্য নমনীয়তায় উইকেটের সব দিকে রান করেন। এবং শেষ পর্যন্ত সিডনি টেস্টে তাঁর সেই ২৪১ রানের ইনিংস একটাও কভার ড্রাইভ না মেরে। |
পাঠ ৪ |
সফল ব্যবসায় সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো সামলানোই আসল
সচিন যখন খুব বেশি তাপমাত্রায় ম্যাচ খেলতেন, তখন মাঠে নেমে ফিটনেস আর স্ট্যামিনা বজায় রাখার উপর অসম্ভব গুরুত্ব দিতেন। অবাক করা একটা কাজ করতেন উনি। ম্যাচের আগের দিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে যত বেশি সম্ভব জল খেয়ে রাখতেন। যাতে পরের দিন মাঠে নেমে লম্বা ইনিংস খেলতে হলেও ফ্লুইডের অভাবে শরীরের কোনও পেশিতে টান না ধরে। বাকিটা করে দিত ওঁর সহজাত ক্রিকেট দক্ষতা। |
পাঠ ৫ |
শিল্পে সাফল্য নির্ভর করে উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগানোর উপর; ক্রমে সেটাই বদলে যায় ‘মাসল মেমারি’ অথবা মেধা সম্পদে
তেন্ডুলকরের প্রতিদিনের রুটিনটা ছিল সকাল সাতটা থেকে ন’টা অনুশীলন। সাড়ে ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে ম্যাচ। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধে সাতটা আবার অনুশীলন। এটা অবশ্য সেই সময়ের রুটিন, যখন ওঁর বয়স ছিল বারো। এই রুটিনের উপর এক বার স্কুলের ছুটিতে একটানা চুয়ান্ন দিন ম্যাচ খেলেছিলেন কোনও বিশ্রাম ছাড়াই। |
পাঠ ৬ |
কোনও কারখানার প্রযুক্তি কত উন্নত সেটা বোঝার অন্যতম উপায় সেখানে কত কম কাঁচামালে বা খরচে কত বেশি উৎপাদন হচ্ছে
নেটে তেন্ডুলকর সাধারণত বোলারদের ষোলো গজ থেকে বল করতে বলেন। এক বার বলটা তাঁর গায়ে লাগায় বোলার এগিয়ে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তেন্ডুলকর নাকি তাঁকে উল্টে বলেছিলেন, “আমাকে যতটা সম্ভব অস্বস্তিতে ফেলে যাও!” ১৯৯৮-এ শেন ওয়ার্নের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণনকে ‘নিয়োগ’ করেছিলেন তেন্ডুলকর। শিবরামকৃষ্ণনের কাজ ছিল রাউন্ড দ্য উইকেট এসে বলটা রাফে ফেলা (যেটা তেন্ডুলকর নিজে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করিয়েছিলেন)। নিট ফল: অক্লান্ত ব্যাটিং প্র্যাক্টিসে উনি ওয়ার্নের
সম্ভাব্য সব রকমের ডেলিভারি
খেলার এমন অভ্যাস করে ফেলেন
যে কোন বলটা কী ভাবে সামলাবেন সেটা একেবারে মজ্জাগত হয়ে
যায়। এর পরে টেস্ট সিরিজে তেন্ডুলকরের হাতে ওয়ার্নের ‘খুন’ হওয়াটা ইতিহাস। |
পাঠ ৭ |
ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য কোন কৌশল বাছবেন, সেটা গোড়াতেই জানা জরুরি গুণমান বাড়ানো, না খরচ ছাঁটাই
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে তেন্ডুলকর সেঞ্চুরি করেছিলেন। ইনিংসটায় কিন্তু নিজের পরিচিত ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ের রাস্তায় হাঁটেননি উনি। বরং প্রতিটা স্ট্রোক খেলেছিলেন অসম্ভব মেপে তেমন জোরেও নয় যে বল সটান আউটফিল্ডারের হাতে চলে যাবে। আবার তত আস্তেও নয় যে ক্লোজ ইন ফিল্ডাররা দ্রুত আটকে দেবে। ফল: যে শটে এক রান আসার কথা তাতে দুই নিয়ে আর দুইগুলোকে তিন-এ বদলে নিয়েছিলেন তেন্ডুলকর। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল পনেরো। |
পাঠ ৮ |
নিখুঁত হওয়ার পিছনে ধাওয়া করলে উৎকর্ষ আপনিই আসবে
নিজের প্রতিটা টেস্ট ইনিংসের বল-বাই-বল রিপ্লে দেখেন তেন্ডুলকর। |
পাঠ ৯ |
প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে আধুনিক প্রযুক্তিতে লগ্নি জরুরি। তাতে প্রাথমিক খরচ হয়তো বাড়বে। কিন্তু রিটার্নও বাড়বে বহু গুণ
চোট পেলেও তেন্ডুলকর সাধারণত রানার নিয়ে খেলতে চান না। ওঁর কথায়, “রানটা হবে কি না, সেটা আমিই ভাল বুঝব। তাই রানারের তুলনায় এমনিতেই গতিতে দু’গজ এগিয়ে থাকব।” |
পাঠ ১০ |
বাকিরা যখন বাজারের দখল বাড়াতে ব্যস্ত, যারা সেরা, তারা তখন নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তির জোরে তৈরি করে নেয় একটা আস্ত নতুন বাজার টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকাররা আবিষ্কার করেন যে, তেন্ডুলকর ব্যাট করার সময় অবধারিত ভাবে শট খেলার ঠিক আগে একটা অস্ফুট শব্দ শোনা যাবে।
সেই শব্দের রহস্যভেদে তাঁরা স্টুডিয়োয় ফিরে গিয়ে তেন্ডুলকরের ব্যাটিং ফ্রেম ধরে ধরে স্লো-মোশনে পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল শব্দের উৎস বল নয়। ব্যাটে-প্যাডে ঘষা লাগা বা ওই জাতীয় অন্য কোনও কিছুও নয়। ধন্ধে পড়া ধারাভাষ্যকাররা অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, শব্দটা একমাত্র ব্যাটসম্যানের থেকেই আসা সম্ভব।
এই ধারণার ভিত্তিতে আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত চালিয়ে অবশেষে সাফল্য এল! দেখা গেল প্রতিটা বল ব্যাটে খেলার আগে তেন্ডুলকর মুখে বলে নিচ্ছেন সেই শটে কত রান করবেন।
যে বলটায় সুযোগ আছে বুঝছেন, ব্যাটে খেলার আগে বলছেন,
“দুই!” আর যখন মনে করছেন একেবারে ললিপপ ডেলিভারি, বলে দিচ্ছেন ‘চার!’
লেখক ক্রীড়া সাংবাদিক
হিসেবে ১৯৮৯ সালে করাচিতে
সচিনের টেস্ট অভিষেক দেখেছেন। পরে পেশা বদলে বাণিজ্য নিয়ে
লেখালেখিতে মন দেন। |
|
|
২৪ বছরে ২৪ পরিবর্তন
(১৫.১১.১৯৮৯ ১৮.১১.২০১৩) |
৯ নভেম্বর ১৯৮৯
পতন হল বার্লিন
প্রাচীরের।
আবার একত্রিত
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি |
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০
২৭ বছরেরও বেশি কারাবাসের পর রবেন
আইল্যান্ডের
কারাগার থেকে মুক্তি
পেলেন নেলসন ম্যান্ডেলা |
|
২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০
ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্যর
টিমোথি
বার্নার-লি তাঁর আবিষ্কৃত ‘ওয়ার্ল্ড
ওয়াইড ওয়েব’কে আরও নিখুঁত করলেন |
১৯৯১
বর্ণবৈষম্যের অবসান
ঘটল দক্ষিণ আফ্রিকায় |
জুন ১৯৯২
ভারতে কেব্ল টিভির সূচনা হল |
৬ ডিসেম্বর ১৯৯২
ধ্বংস বাবরি মসজিদ |
১২ মার্চ ১৯৯৩
তেরোটা বোমা বিস্ফোরণে
কেঁপে উঠল মুম্বই।
উঠে এল
দাউদ ইব্রাহিমের নাম |
২৭ এপ্রিল ১৯৯৪
প্রথম বারের জন্য সর্বজাতির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১০ মে দক্ষিণ আফ্রিকার
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা |
জুন ১৯৯৫
আইনস্টাইন ও সত্যেন বসুর অনুমান
মতো
পদার্থের পঞ্চম দশা শনাক্ত হল |
জুলাই ১৯৯৫
ভারতে চালু হল
মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থা |
৩০ জুন ১৯৯৭
প্রকাশিত হল ‘হ্যারি পটার
অ্যান্ড দ্য ফিলোজফার্স স্টোন’ |
৩১ অগস্ট ১৯৯৭
গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন
‘প্রিন্সেস অব ওয়েলস্’ ডায়ানা |
|
জুলাই ১৯৯১
ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ হল
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী
পি ভি নরসিংহ রাও
ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-র হাত ধরে |
২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১
ভেঙে গেল পূর্বতন
সোভিয়েত ইউনিয়ন |
৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮
সের্গেই ব্রিন আর লরেন্স-ই-পেজ
প্রতিষ্ঠা করলেন গুগল |
মে ১৯৯৯
কার্গিল
যুদ্ধের শুরু |
জুন ২০০০
তৈরি হল মানুষের
জিন-মানচিত্র |
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১
সন্ত্রাসী হানায় ভেঙে পড়ল
নিউ ইয়র্কের
টুইন টাওয়ার। উঠে এল
ওসামা বিন লাদেনের নাম |
৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৪
মার্ক জুকারবার্গ ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন |
২৬ ডিসেম্বর ২০০৪
চোদ্দোটা দেশে প্রায় দু’লক্ষ তিরিশ
হাজার মানুষ মারা
গেলেন সুনামিতে |
২৬ নভেম্বর ২০০৮
মুম্বই আক্রমণ করল আজমল
কসাব-সহ কিছু উগ্রপন্থী |
২০ জানুয়ারি ২০০৯
আমেরিকার প্রথম আফ্রিকান-অমেরিকান
প্রেসিডেন্ট হলেন বারাক ওবামা |
|
২ মে ২০১১
ওসামা বিন লাদেন মারা গেলেন
পাকিস্তানের অবেটাবাদে |
৪ জুলাই ২০১২
আবিষ্কৃত হল ঈশ্বরকণা |
|
|