ল মানেই অবধারিত বৃষ্টি!
সালটা বোধ হয় ১৯৯৭। গল-য়ের লাইটহাউস রিসর্টে উঠেছিলাম আমরা। এক্কেবারে সমুদ্রের ধারের রিসর্ট। আর ঘরে বসেই রোজ সকালে দেখতাম সমুদ্রের দিক থেকে মেঘের দঙ্গল তেড়ে আসছে গলের দিকে। এবং ম্যাচ ধুয়েমুছে সাফ কলড্ অফ।
এই রকমই একটা বৃষ্টি ঝরা দিনে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম সিধু, সচিন আর টিমের আরও একজন, যার নামটা এখন মনে নেই, টেবল টেনিস র্যাকেট হাতে রিসর্টের প্লে এরিয়ার দিকে যাচ্ছে।
সচিন আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “টেবল টেনিস খেলতে পারো?” মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
অনেক দিন খেলার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে যা হয়। প্রথম ক’টা শট হয় টেবলের বাইরে গিয়ে পড়ল নয়তো নেটে আটকে গেল। কয়েক বার এই রকম হওয়ার পর বিশ্বাস করুন, সচিন আমার উপর সত্যিই রীতিমতো চটে উঠল! আমার দিকে ফিরে খুব ঠান্ডা গলায় বলল, “তুমি কি প্লিজ বলটা শুধু টেবলের উপর রেখে যেতে পারবে? বাকি পয়েন্ট তোলার ব্যাপারটা আমি দেখে নেব।” আমি আমতা আমতা করে ফের মাথা নাড়লাম। এ বার বেশ নার্ভাস হয়েই।
খান তিনেক ডাবলস ম্যাচ খেলার পর সচিন বলল, “চলো এ বার সিঙ্গলস খেলা যাক।” আমি তখনও বেশ নার্ভাস হয়ে আছি। বলে ফেললাম, “সচিন, তুমি হলে চ্যাম্পিয়ন। তোমার সঙ্গে খেলে গো-হারান হারতে চাই না।”
সে দিন ও যে উত্তরটা দিয়েছিল, চুম্বকে সেটাই আমার কাছে সচিন বলতে আমি ঠিক যা বুঝি। ও বলেছিল, “ঠিক আছে, গেমটা ১০-০ ধরে নিয়ে নামা যাক। দেখি, এখান থেকে শুরু করে আমি তোমাকে শেষ পর্যন্ত হারাতে পারি কি না।”
এই হল সচিন তেন্ডুলকর।
সচিনের সঙ্গে ওর বিভিন্ন সফরের সহযাত্রী হিসেবে আজ চব্বিশ বছর কেটে গিয়েছে। গল-য়ের ওই ছোট্ট ঘটনাটার মতো আরও কত অভিজ্ঞতা যে ভিড় করে আছে স্মৃতিতে!
মজা দেখবে?
তবে সে-সবে ঢুকে পড়ার আগে আসুন, আপনাদের ১৯৯০-এর গোড়ার দিকের আর একটা কাহিনি শুনিয়ে ফেলি। সে যুগে ভারতীয় দল কোনও লম্বা সফরে রওনা দেওয়ার আগে ক্রিকেটারদের বাড়ি গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলার খুব চল ছিল। মানে সিরিজটা নিয়ে তারা কী কী প্ল্যান করেছে, কী ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই সব আর কী।
আমিও এমনই একটা লেখার জন্য সচিনের সঙ্গে দেখা করতে বান্দ্রার কলানগরে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। কুশল বিনিময় পর্ব সেরেটেরে গুছিয়ে বসেছি। দেখলাম টেলিফোনের রিসিভার ক্রেডল থেকে পাশে নামিয়ে রাখা।
সচিনের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “অ্যায়সা কিঁউ রাক্খা টেলিফোন?” টেলিফোনটা এ ভাবে কেন রাখা?
সচিন মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল, “মজা দেখোগে?” এর পর ফোনটা ঠিক করে রাখতেই সেটা ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। ও এ বার রিসিভারটা পাশে নামিয়ে রাখল। ফোন চুপ করে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর সচিন আবার ফোনটা ঠিক করে রাখল। আবার বেজে উঠল দূরভাষ যন্ত্র। নামিয়ে রাখতে আবার চুপ। সচিন তিন-চার বার ব্যাপারটার ডেমো দেখানোর পর লাজুক হেসে ফেলল। পরে ওর কাছেই শুনলাম, ওর বাবার নাম মুম্বইয়ের টেলিফোন ডিরেক্টরিতে রয়েছে। আর ওর গুণমুগ্ধরা সেই নম্বরে অবিরাম ফোন করে যায়।
তিন বছর ধরে ভিডিয়ো গেমস
সচিনের কেরিয়ারের গোড়ার দিকে ওর সঙ্গে ট্যুরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো অনেক বেশি অন্তরঙ্গ। মনে আছে, ১৯৯২-এর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ব্লুমফন্টেনে ভারতীয় দলের টিম হোটেল লাগোয়া একটা শপিং মল ছিল। খেলা বা প্র্যাক্টিস নেই, এমন একটা দিনে হঠাৎ দেখি সচিন টুকটুক করে মলের দিকে হাঁটা দিয়েছে। মরাঠিতে জানতে চাইলাম, “আজ কিত্থে?”
উত্তরটা শুনে খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে যাই! সচিন বলল, “মল-এ যাচ্ছি। ভিডিয়ো গেমস খেলব।” এর প্রায় ঘণ্টা তিনেক কেটে যাওয়ার পর সরেজমিনে ব্যাপারটা তদন্ত করতে মল-এ পৌঁছে দেখি সচিন তখনও ভিডিয়ো গেমস পার্লারে। একেবারে নিজস্ব জগতে বুঁদ হয়ে গাড়ির রেসিং করে চলেছে! দেখে মনে হবে, বাবা-মা ওকে পকেট ভর্তি করে এক টাকার কয়েন দিয়ে বলেছেন, যাও বাবা, যত খুশি খেলে উড়িয়ে এসো। কোনও বাচ্চা বাবা-মায়ের এমন ঢালাও অনুমতি পেলে ঠিক যে রকম রোমাঞ্চিত হবে, সচিনের উত্তেজিত খেলে যাওয়া আর উদ্ভাসিত অভিব্যক্তির মধ্যে সেই রোমাঞ্চটাই ধরা পড়ছিল।
ও জানে গুড লাইফ বলতে ঠিক কী বোঝায়
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের যে গল্পটা শোনালাম, সেই সময়টায় সচিন বিস্ফারিত নেত্রে পৃথিবীটাকে দেখছে আর আবিষ্কার করছে। এর পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারকা থেকে মহাতারকায় ওর যত উত্তরণ হতে লাগল, ততই ওর জীবনকে দেখার চোখটা পাল্টাতে থাকল। আজকের সচিন স্মার্ট, শৌখিন। আদব-কায়দায় চৌখস। গুড লাইফ বলতে কী বোঝায়, সেটা আজকের সচিন বাস্তবিকই জানে। ও জানে, পৃথিবী জুড়ে সেরা শেফ-দের ঠিকানা, ‘মিশেলিন স্টার’ পাওয়া রেস্তোরাঁগুলো কোথায়। আগে সচিন ছিল একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।
আর আজ? মনে আছে ভারতীয় দলের সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে আমরা সবাই মেলবোর্নের একটা ওয়াইনারি দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের গ্রুপে একমাত্র সচিনই ছিল যার ওয়াইন আর ওয়াইনারি সম্পর্কে সব কিছু জানা। তখনই আবিষ্কার করি, আজকের সচিন এমন একজন মানুষ যার পছন্দগুলো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞান-ভাণ্ডারের নানা উপাদান থেকে আহরণ করা, আর অবশ্যই খুব উঁচু দরের। যাকে বলে ‘একলেকটিক টেস্ট’-এর। কিন্তু এখানেও একজন সুপারস্টার হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের সঙ্গে ওর আচরণে এতটুকু কোনও খুঁত ধরা যাবে না।
সচিন না বলতে শিখেছে
সচিনের সঙ্গে ট্যুর করার অভিজ্ঞতাটা পাল্টাতে থাকে সেই সময় থেকে যখন থেকে ক্রিকেটে নিরাপত্তার কড়াকড়িটা শুরু হল। সেই সময়টায় টিম হোটেলগুলো হোটেল কম আর সেনা-দুর্গ বেশি বলেই মনে হতে শুরু করেছিল। যেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের চলাফেরার উপর জারি হচ্ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ বিধিনিষেধ।
তাই ট্যুরে গিয়ে আমি সচিনের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করি। কারণ ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুব আন্তরিক হলেও আমি চাইতাম না যে ও কোনও ভাবে বিব্রত হোক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি, সচিনের সঙ্গে কথা বলার সেরা সুযোগ হচ্ছে যখন ও তোমাকে নিজে ফোন করবে। আর তখন মনের প্রাণের অনেক কথা বলবে। একমাত্র সেই সময়েই ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনি বুঝতে পারবেন যে, দুনিয়ার সামনে সচিনের যে পাবলিক ইমেজটা গড়ে উঠেছে, একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে সেই ভাবমূর্তির থেকে ও ঠিক কতটা আলাদা ।
সচিনের ব্যক্তিত্বে এই পরিবর্তনটা অবশ্য এক অর্থে ওর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তারই মাসুল। এ দেশে এক জন সেলিব্রিটি যদি খুব সহজ-সরল আর ভদ্র মানুষ হয়, লোকে সব দিক থেকে তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দেয়। তাই ভারতে সেলিব্রিটিদের ‘না’ বলতে জানতে হয়। সচিন আগে এই ‘না’-টা বলতে পারত না। কিন্তু আজকাল ‘না’ বলতে শিখে গিয়েছে।
আজ ও যখন অবসরের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ছে, তখন আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তো বলব, উফ্, বাঁচা গেল! এর প্রধান কারণ, আমরা, ভারতীয়রা আজ সচিনের অবসরটাকে যেন দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়েডিং করে ফেলেছি। আর ওর অবসরটা দ্য গ্রেট ‘বিদাই’। অবসর ঘিরে এই আড়ম্বরের আতিশয্যটা আমার কাছে বেশ অস্বস্তিকর। এতে সচিনের অবসরের সারল্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে। উল্টে ব্যাপারটা যেন সবার কাছে একটা বিশাল সুযোগ। যে সুযোগটাকে আমরা সবাই নিংড়ে দুইয়ে নিঃশেষ করে নিতে চাইছি।
শেষ করার আগে বলতে চাই, সুনীল গাওস্কর অবসরের পর প্রথম টেস্ট ম্যাচে অরুণ লাল আর কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে ওপেন করতে নামতে দেখে মনে মনে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল, এটা ক্রিকেট হতে পারে না, সানি গাওস্কর কোথায়?
আমার মনে হয় সেই অনুভূতিটা এ বারও হবে। গাওস্করের অবসরের দু’ বছর পর সচিন এসেছিল।
ঈশ্বরই জানেন, এ বারের অপেক্ষাটা কত দীর্ঘ!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.