|
|
|
|
এ বার হারাধনের শেষ ছেলে
ধোনিদের আর অভিভাবক রইল না। লিখছেন সুরেশ মেনন |
কোনটা বেশি বিস্ময়ের?
সচিন তেন্ডুলকরের দু’শোটা টেস্ট খেলা, নাকি দেশের হয়ে অভিষেকের পর চব্বিশ বছরের কেরিয়ারে মাত্র সতেরোটা টেস্ট মিস করা?
তেন্ডুলকর-পরবর্তী ভারতীয় ড্রেসিং রুম কোন জিনিসগুলো আর দেখতে পাবে না? পাঁচটা ‘E’ এক্সপিরিয়েন্স, ইকোয়ানিমিটি, এনার্জি, এন্ডিওরেন্স, এন্টারটেনমেন্ট।
বাংলায় অভিজ্ঞতা। অবিচলিত মনোভাব। অফুরন্ত শক্তি। সহনশীলতা। বিনোদন।
যার প্রথমটা সচিন পেয়েছে এত বছর ধরে খেলে। বাকিগুলো প্রথম থেকেই ওর টেম্পারামেন্টের অংশ।
একজন বিরাট পারফর্মার মাঠ ছাড়ার পরে তার অভাব প্রত্যক্ষ ভাবে যতটা বোঝা যায়, ততটাই টের পাওয়া যায় বিমূর্ত ভাবে। সচিনের ব্যাটিং লোকে মিস করবে, খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ও যে একজন ব্যাটসম্যানের চেয়ে আরও বেশি কিছু ছিল। সচিন ছিল একটা উপস্থিতি।
আজ ভারতীয় ব্যাটিং সচিনের উপর ততটাও নির্ভর করে না যতটা করত ওর কেরিয়ারের সেরা সময়ে। ক্রিকেটের দিক থেকে দেখলে এই ইন্ডিয়া হয়তো সচিন-নির্ভরতা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে প্রথম টেস্ট খেলতে যে দল নামবে, তাদের নিশ্চয়ই একটা কথা মনে হবে। মনে হবে এত দিন একটা কিছু ছিল, যা আজ আর নেই। অনেকের কাছে ব্যাপারটা হবে বাড়ি ফেরার মতো, যে বাড়িতে অভিভাবক আর কেউ নেই। কারও আবার মনে হবে একটা কলেজ রিইউনিয়নে এসেছি, যেখানে সব চেয়ে ভাল বন্ধুই এল না!
যা-ই হোক, এখন পাঁচটা ‘E’ আরও খুঁটিয়ে দেখা যাক। |
|
অভিজ্ঞতা |
সচিন তেন্ডুলকরের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার বিশ্ব আর দেখেনি। যার মানে, ও সমস্ত ধরনের পরিবেশে খেলেছে। যার মানে, ও জানে বোলারের কোন প্রশ্নের উত্তর কী ভাবে দিতে হবে। যার মানে, মাঠ হোক বা মাঠের বাইরে, কোনও প্রশ্নপত্রই সচিনের অজানা নয়।
বলতে পারেন ও খেলাটার একক বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে ছাত্ররা শেখে ওর সংস্পর্শে এসে, ওর কাছ থেকে খেলাটা আত্মস্থ করে, ওকে সরাসরি প্রশ্ন করে, বা ওর খেলা দেখে।
একটা ড্রেসিং রুম যখন এত বিশাল একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সেটা সামলে উঠতে সময় তো লাগবেই। কিন্তু যদি সচিনের কাছ থেকে শিক্ষাগুলো ঠিকঠাক নেওয়া যায়, তা হলে সেই উত্তরাধিকার ওর যাবতীয় রেকর্ড, রান, ম্যাচ, গড়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে। |
অবিচলিত মনোভাব |
ভারতীয় ক্রিকেট সত্যিই আশীর্বাদধন্য। সাম্প্রতিক কালে সে এমন কিছু ক্রিকেটার পেয়েছে, যারা সঙ্কটের মধ্যেও শান্ত থাকতে পারে। আর ওদের এই প্রশান্তি মাঠের মধ্যেকার অনেক সম্ভাব্য বিস্ফোরণই আটকে দিয়েছে। যেমন অনিল কুম্বলে। যেমন রাহুল দ্রাবিড়। যেমন ভিভিএস লক্ষ্মণ।
অবিচলিত থাকার এই বিরল ক্ষমতা সচিনেরও আছে। ঝগড়াঝাঁটির ঊর্ধ্বে থাকার ক্ষমতা। বাইরের জগতের টানা চিৎকার আর যাবতীয় আবদার মন থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা। টিমমেটদের উপর ওর প্রভাবও অপরিসীম।
নতুন প্রজন্মের টিম ইন্ডিয়ায় টেম্পারামেন্টের বিচারে সচিনের একেবারে উলটো দিক থেকে শুরু করেছিল বিরাট কোহলি। কিন্তু এর মধ্যেই ওর ভেতর একটা পরিণতিবোধ এসেছে, যেটা সরাসরি তেন্ডুলকরের কাছ থেকে ধার করা। সচিনের ব্যাটন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধোনি আর চেতেশ্বর পূজারাও। এরা কেউ সহজে ঘাবড়ে যায় না। আর এদের শান্ত, ধীরস্থির মনোভাব আশেপাশের সবাইকে অনুপ্রেরণা জোগায়। |
অফুরন্ত শক্তি: প্রশান্তি |
সঙ্গে এনার্জি কম্বিনেশনটা বিরল বললেও কম বলা হয়। চল্লিশতম জন্মদিন পেরিয়েও টিমের সব চেয়ে চনমনে সদস্য সচিন। ফিল্ডিংয়ে কোনও দিন ও ঢিলে দেয়নি। আউটফিল্ড থেকে ওর থ্রো সব সময় টার্গেটে আসে। দরকারে বোলার বা ক্যাপ্টেনকে ডেকে কথা বলা থেকেও পিছিয়ে আসেনি সচিন। সব সময় ওর মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটা বাচ্চা ছেলে। যে নিজের প্রিয় খেলা খেলতে পারার সৌভাগ্যে সব সময় একটা বিস্ময়, একটা আনন্দে মজে। নিজের খেলা প্রতিটা ম্যাচে সচিন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। ওর মধ্যে কোনও আপস নেই। নিজের সেরা খেলার চেয়ে কম কিছুতে সন্তুষ্টি নেই। |
|
সহনশীলতা |
পরপর চোটের ধাক্কায় প্রায় এক দশক আগে সচিন যে খেলা ছেড়ে দেওয়ার কত কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, সেটা আজ কল্পনা করা খুব কঠিন। ওর পায়ের আঙুল, ওর পিঠ, ওর কাঁধ, ওর কনুই, ওর দু’টো হাত সব জাতীয় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। টানা দেড় দশক খেলার ধকলটা তখন যেন বোঝা যাচ্ছিল।
ওই সময় এক বার সচিন বলেও ফেলেছিল, “প্রত্যেক সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, নিজেকে নিয়ে নিজের অনুভূতিটা আগের মতো থাকে না।”
এত কিছুর পরেও কিন্তু সচিন হাল ছাড়েনি। চোট আর ফিটনেসের সমস্যা কী ভাবে কাটিয়ে উঠতে হয়, তার অসাধারণ একটা শিক্ষা ওর কাছে আমরা পেয়েছি। পাশাপাশি এই বার্তাটাও সচিন দিয়ে রেখেছিল যে, যন্ত্রণাকে ও নিজের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে দেবে না। আজকের প্রজন্ম হয়তো ভাবতেই পারবে না যে, একটা সময়ে কত তুচ্ছ সব কারণ দেখিয়ে প্লেয়াররা জাতীয় দল থেকে সরে দাঁড়াত। যন্ত্রণার কাঁটাতার টপকে ব্যাট করে করে তেন্ডুলকর কিন্তু এই জিনিসটা পালটে দিয়েছিল। হ্যাঁ, একটা আপস অবশ্য ওকে করতে হয়েছে। ভারী ব্যাটের ওজন সামান্য একটু কমানোর আপস। ওর চেয়ে কম (কিছু ক্ষেত্রে মন-গড়া) চোট পাওয়া, ওর চেয়ে নিচু মানের প্লেয়ারদের কাছে যেটা একটা দৃষ্টান্ত। |
বিনোদন |
ওর মধ্যে যে ভীষণ হুল্লোড়বাজ ছেলেটা লুকিয়ে আছে, যাকে মাঝেমধ্যে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়া থেকে প্রায় টেনে বের করতে হত, সেই ছেলেটার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক কোনও দিন নষ্ট হতে দেয়নি সচিন। বড় হয়ে সেই ছেলেটা এখন এমন একজন মানুষ, যে সব সময় হাসিঠাট্টা ভালবাসে। যার সরস কোনও মন্তব্যে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ নিমেষে হালকা হয়ে যায়।
এই সচিন, যে নিজেকে কখনও প্রকাশ্যে আনেনি, তাকে ভারতীয় ড্রেসিংরুম ভীষণ মিস করবে। এই তো বছরদু’য়েক আগেও যুবরাজ সিংহের মতো টিম ইন্ডিয়ার পরের প্রজন্ম যখন সচিনকে ‘কাকা’ বা ‘দাদু’ বলে ঠাট্টা করত, তখন নিজেকে নিয়ে ইয়ার্কিতে অনায়াসে যোগ দিয়েছে সচিন।
মানুষ সচিনের এই দিকটা একান্ত ব্যক্তিগত। ভারত যখন রান তাড়া করত, তখন এই সচিন কাউকে সিট ছেড়ে উঠতে দিত না। এই সচিন সব সময় হাসিঠাট্টা করত। এক শতকের
চার ভাগের এক ভাগ ধরে ভারতীয় ড্রেসিংরুম তার চরিত্র পেয়েছে এই সচিনের কাছ থেকেই। |
লেখক-সম্পাদক
‘উইজডেন ইন্ডিয়া অ্যালম্যানাক’ |
|
|
|
|
|