|
|
|
|
|
ডন ১০
সচিন ৮১/২
ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র তিনিই জীবিত! আটচল্লিশে ডনের বিদায়ী
শূন্য দেখেছিলেন ওভাল ড্রেসিংরুমে বসে। সচিনের
শেষ করাও
দেখতে চান
সিডনির
বাড়ি বসে টিভিতে। চুরাশি বছরের নিল হার্ভি অস্ট্রেলিয়া
থেকে
এক্সক্লুসিভ ফোন সাক্ষাৎকার দিলেন গৌতম ভট্টাচার্য-কে |
|
চাপ নেওয়ার ক্ষমতা |
দু’জনেরই সাঙ্ঘাতিক। দু’জনের কেউ অমানুষিক চাপে নুয়ে পড়ার কখনও লক্ষণ দেখায়নি। আমি ভারতে বছর পনেরো আগে ম্যাচ দেখতে গিয়ে দেখে এসেছিলাম, সচিন কী পরিমাণ লোড নেয়। সিডনিতে বসে শুনি বা চ্যানেলে দেখি, সেই চাপটা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। গোটা ভারতবর্ষকে নাকি ওকে ব্যাটিং ক্রিজে বইতে হয়। হতেই পারে তার সেই ক্ষমতাটা বিস্ময়কর। কিন্তু ডনও কোনও অংশে কম ছিলেন না। আমি দিনের পর দিন দেখা অভিজ্ঞতা বলতে পারি। এত বড় ক্রিকেট চুম্বক জীবনে আর দেখিনি। সাক্ষাৎ ম্যাগনেট ছিলেন ডন! এত বছর বাদেও কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হয় সত্যিই ঘটেছে কি না! কিন্তু এ তো আমার নিজের চোখে দেখা। ডনের হাতে যখন ব্যাট, মাঠ ভরে গিয়েছে কাতারে কাতারে। যেমন ফর্টিএইট ট্যুরে আমাদের প্রতিটা কাউন্টি ম্যাচও কানায় কানায় ভরে থাকত। আবার যে-ই ডন আউট হয়ে গেল, মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। দিনের পর দিন দেশে এবং বিদেশে চলমান অস্ট্রেলিয়া বলতে তখন ব্র্যাডম্যানকেই ধরা হত। সেই চাপ এত সফল ভাবে সামলানোটা কম কথা নাকি? |
অবসরের সময় নির্বাচন |
এই জায়গাটায় ডন হারিয়ে দিয়ে গেলেন সচিনকে। আমি বলব ওঁর টাইমিংটা এখানে বেটার। আটচল্লিশের ইংল্যান্ড সফরে যখন যাই, আমার বয়স উনিশ। আর ডন আমার চেয়ে ঠিক একুশ বছরের বড়। তখন ওঁর তিরিশ দশকের রমরমা নেই। রান মেশিন ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যেমন যে ওঁর ব্যাটের তলায় আসত, সে-ই দ্রুত চাপা পড়ত সেই পরিস্থিতি ছিল না। সে বারের সফরে অস্ট্রেলিয়ার সফলতম ব্যাটসম্যান ছিলেন আর্থার মরিস। মরিস তিনটে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এর পরেই ছিলেন ব্র্যাডম্যান। টেস্টে ওঁর সেঞ্চুরি ছিল দু’টো। লিডসের সেঞ্চুরিটা তো অনবদ্য ছিল। এর থেকেই প্রমাণ, টেস্ট জীবনের অন্তিম সময়েও ফর্ম ওঁর পিছু ছাড়েনি। সে যতই শেষ ইনিংসে শূন্য থাক। সচিন সে দিক দিয়ে প্রায় গত দু’বছর টেস্ট সেঞ্চুরি পাচ্ছে না। আমার মনে হয়, ব্যাটসম্যানদের এমন সোনার সময়ে, যখন নিয়মকানুন সবই তাদের পক্ষে, তখন দু’বছর সেঞ্চুরি না-পাওয়া মানে পরিষ্কার পুরনো দাপটটা চলে যাওয়া। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি সচিন তুমি একটু বেশি-ই টেনে ফেলেছ। আর ছ’মাস আগে হলে ব্যাপারটা আরও স্টাইলিশ হত। |
ব্যাটসম্যানশিপের সর্বকালীন বিচার |
আমার মতে ডনের দশে দশ পাওয়া উচিত। আমি ওঁর নম্বর কাটার কোনও জায়গাই খুঁজে পাচ্ছি না। সর্বকালের সেরা পাঁচ জন ব্যাটসম্যান যদি আমাকে বাছতে হয়, এক-য়ে চোখ বুজে ব্র্যাডম্যান। পাশে রাখার মতো কেউ নেই। আজ এই বৃদ্ধ বয়সেও বারবার মনে হয়, প্রকৃতি আরও একটা তেন্ডুলকর উৎপন্ন করলেও করতে পারে, কিন্তু ব্র্যাডম্যান আর হবে না! তবে দশে দশ পাওয়া সবচেয়ে কৃতী ছাত্রের পর আমি সচিনকেই মনে করতে চাই। ওকে দিতে চাই দশে সাড়ে আট। এখন অস্ট্রেলীয় মিডিয়ায় খুব লেখালিখি দেখছি, রিকি পন্টিং নাকি ডন-পরবর্তী অধ্যায়ের সর্বকালের সেরা। মতামতটা এক কথায় রাবিশ। পন্টিংয়ের দাদাগিরি এমন সময়ে, যখন ব্যাটসম্যান শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করে। যখন উইকেট ফ্ল্যাট। যখন সমস্ত নিয়ম বদলেছে ব্যাটসম্যানের সুবিধে করে। সে দিক থেকে আমার দেখা অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যান হল গ্রেগ চ্যাপেল। গ্রেগের আগে অবশ্য আরও তিনটে নাম রাখতে চাই। নামগুলো এ ভাবে আসা উচিত; ১) ব্র্যাডম্যান, ২) সচিন, ৩) হাটন, ৪) ভিভ, ৫) উইকস্, ৬) চ্যাপেল। |
|
|
ছেলেটা অনেকটা আমার মতো খেলে: ডন ব্র্যাডম্যান |
|
ক্রিজে সচিন আর ডন |
সচিনের একটা ইনিংস দেখেছিলাম চেন্নাইতে মার্ক টেলরের টিমের বিরুদ্ধে। টিভিতে সব সময় বোঝা যায় না। কিন্তু মাঠে বসে ওটা দেখার পর অবিশ্বাস্য লেগেছিল। ব্যাটিং যে কী রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে, আর পারফেকশনও যে কী পর্যায়ে পৌঁছয়, তার জ্বলন্ত নমুনা ছিল ইনিংসটা। ১৫৫ করেছিল সচিন। উলটো দিকে যে ম্যাকগ্রা আর ওয়ার্ন বলে কেউ বল করছিল, সেটা ওই ইনিংস দেখে বোঝা যায়নি। আমি সুনীল গাওস্করেরও খুব ভক্ত ছিলাম। গাওস্করকে তীব্রতম ফাস্ট বোলিং সামলাতে হয়েছে। কিন্তু গাওস্করের হাতে এত শটের রেঞ্জ ছিল না। সচিন সমস্ত রকম শট খেলতে পারে। স্পিনার-পেসার কাউকে ভয় পায় না। বিশ্বের কোনও বোলিং আক্রমণকে আলাদা করে সমীহ করে না। আমার কাছে এটাই গ্রেটনেস। ডন সম্পর্কে ইদানীং বলা হচ্ছে, উনি চার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলার খেলেননি, রিভার্স সুইং খেলেননি, দুসরা খেলেননি। আমার বিনীত বক্তব্য, ব্র্যাডম্যানের সময়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ মোটেও খারাপ ছিল না। আর কন্সট্যানটাইনকে উনি যে খেলতেন, সে কি স্পিন বোলার ছিল? ওঁর আমলে হেলমেট ছিল না, ব্যাটসম্যানের অখাদ্য সব পিচে ক্রিকেট খেলা হত। কী সব রদ্দি ব্যাট দিয়ে উনি খেলতেন, যা আজকাল ছোকরারা হাতেই তুলবে না। আমার মনে হয়, মার্শাল বা আক্রম বিপরীতে দাঁড়ালেও ডন ঠিক ম্যানেজ করে নিতেন। বডিলাইন সিরিজেই তো ওঁর পঞ্চাশের ওপর গড় ছিল। সুবিধা অনুযায়ী ব্যাটসম্যানের পক্ষে সব নিয়মকানুন থাকা অবস্থায় আজকের ফ্ল্যাট উইকেটে ওঁকে থামানো যেত বলে আমার মনে হয় না। একটা মানুষের গড় কখনও ৯৯.৯৬ হতে পারে! তা-ও যাঁর সেরা সময় কি না সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার কেড়ে নিয়েছিল। |
ক্রিকেটে অবদান |
ডন অবশ্যই এক। ক্রিকেট মানে ব্র্যাডম্যান। কিন্তু সচিন ঠিক তার পরেই। এখানে আমি ওকে দশে সাড়ে নয় দিতে চাই। ভাবতে খারাপই লাগছে, সচিনেরও কি না অবসরের সময় চলে এল! আসলে সময় চলে যায়, মানুষকেও সরে যেতে হয়। কিন্তু শুধু ইন্ডিয়া নয়, পৃথিবীব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সচিন থেকে যাবে। অস্ট্রেলিয়ায় শেষ কয়েকটা সফরে ও যা সংবর্ধনা পেয়েছে, তা ডনের ইংল্যান্ডে পাওয়া অভ্যর্থনার সঙ্গে তুলনীয়।
|
টিমমেট ও অধিনায়ক |
মনে হয়, মানুষ হিসেবে সচিন আগে থাকবে। আমি সচিনকে তেমন ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখার সুযোগ পাইনি। শুনেছি টিমমেট হিসেবে ও অতুলনীয়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। সুপারস্টার স্টেটাস কখনও জাহির করে না। টিমের কনিষ্ঠতম প্লেয়ারও ওর কাছে গিয়ে সরাসরি পরামর্শ চাইতে পারে। ডন তা ছিলেন না। উনি কথাই বলতেন না। ডনের বাণী ছিল খুব সহজ, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলছ যখন, নিজেই নিজের শিক্ষক হও। উনি কোচিংয়ে একদম বিশ্বাস করতেন না। ফর্টিএইট ট্যুরে টেস্ট ম্যাচে ওঁর সঙ্গে ব্যাট করার সুযোগ হয়নি। কাউন্টিতে দু’তিন বার পার্টনারশিপ হয়েছিল। বললে বিশ্বাস হবে কি না জানি না, একটাও কথা হয়নি। উনি উইকেটের ও দিকে, আমি এ দিকে। ও-সব ব্যাপারই ছিল না যে সফরে সর্বকনিষ্ঠ উনিশ বছরের ছেলেটাকে নিজে থেকে টিপস্ দিই। সেই সফরে আমার রুমমেট ছিলেন স্যাম লক্সটন। দু’বছর আগে মারা যাওয়া লক্সটন ডনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ওঁকে দিয়ে আমি ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করিয়েছিলাম, ভাল ব্যাটিংয়ের রহস্য কী? লক্সটন উত্তরটা নিয়ে এসেছিলেন যে, আউট যদি হতে চাও, একমাত্র তা হলেই আকাশে খেলো। |
|
আমি আর আমার রুমমেট রুদ্ধশ্বাস |
বসে মানেটা এ রকম করেছিলাম; জমিতে আগাগোড়া খেললে আউট হবে না। ব্র্যাডম্যান কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে ভাল ছিলেন। টিমের সবাই ওঁকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধাও করত। এই যে লোকে কিথ মিলারের সঙ্গে ওঁর বিরোধিতার কথা বলে। ওঁরা দারুণ বন্ধু ছিলেন না ঠিক কথা, কিন্তু মিলার যেমন শ্রদ্ধা করতেন ডনকে সেটা ভাবাই যায় না! ডন বেশ ধুরন্ধর ক্যাপ্টেন ছিলেন। টিমের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতেন। যদিও আমার দেখা সেরা অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ডন নন, লিন্ডসে হ্যাসেট। হ্যাসেটের মধ্যে একটা রোম্যান্স ছিল। ম্যাচে সামান্যতম সুযোগ দেখতে পেলেও, উনি ঝাঁপাতেন। একবার অ্যাওয়ে অ্যাসেজে হ্যাসেটের ডিক্লারেশনে আমরা টেস্টও জিতেছিলাম। ডন কিছুতেই ওই সুযোগটা নিতেন না। উনি ঝুঁকি নেওয়ার বান্দাই ছিলেন না। গোটা ব্যাপারটাই ছিল, ঝুঁকিকে নির্মূল করো। |
দু’জনের বিদায়ী স্মৃতি |
ডন এত বড় বড় রান করলেও যে কোনও কারণেই হোক, আমার কাছে ওঁর বিদায়ী স্মৃতি হল, ওভালে শেষ ইনিংসে শূন্য করে আউট হয়ে যাওয়া। উনি কেমন একটা হতভম্বের মতো ড্রেসিং রুমে ফিরে ছিলেন। ফিরে বললেন, “ব্যাপারটা ঠিক এমন হওয়ার ছিল না, তাই না?” ইন্টারেস্টিং হল, আমরা কেউ জানতামই না, আর মাত্র চার রান করতে পারলেই ডনের গড় যে একশো হয়ে যেত। তখনকার দিনে সাংবাদিক, টিভি এ সব ছিল। কিন্তু এখনকার মতো ক্রিকেট স্ট্যাটিস্টিক্সের চল হয়নি। আমরা অনেক পরে জেনেছি যে, ৯৯.৯৬ কেন ১০০-তে পৌঁছল না। আমার কাছে সচিনের দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি বলতে ওর চেন্নাইয়ের ইনিংসটা। তার পাশেই রাখব, বিরানব্বইয়ের সফরে সিডনি টেস্টে ওর সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়ায় ওটাই বিদেশি দলের পক্ষে সব চেয়ে কমবয়সির টেস্ট সেঞ্চুরি। সচিনের শেষ ইনিংস কেমন হবে জানি না। আশা করব দুশোতম-তে যদি বা না-হয়, ইডেনে একটা সেঞ্চুরি করুক। ক্রিকেটে ওর যা অবদান, মহাস্টাইলিশ বিদায় কিন্তু সচিনের প্রাপ্য। টিভির সামনে বসে সিডনি থেকেই ওকে হাততালি দিতে চাই। |
|
|
|
|
|