স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু বা স্মৃতিশক্তি লোপ বা পক্ষাঘাতের কথা বেশির ভাগ মানুষই জানেন। কিন্তু স্ট্রোক থেকে যে মারাত্মক অবসাদের জন্ম হতে পারে, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশও এখনও পর্যন্ত তেমন সচেতন নন। অথচ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, যত মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, তাঁদের এক তৃতীয়াংশই অল্প কিছু দিনের মধ্যে অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। চিকিৎসা না হলে এই অবসাদের জেরে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অবসাদ নানা কারণে হয়। জিনঘটিত কারণে অবসাদ হয়, আবার কোনও ঘটনার জেরে তার অব্যবহিত পরে অবসাদ আসতে পারে। স্ট্রোকের রোগীদের ক্ষেত্রে অবসাদ আসে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটার নামই স্ট্রোক। চিকিৎসকদের মতে, এর ফলে মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব এবং ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অবসাদের জন্ম দেয়। সমীক্ষক দলের সদস্যদের বক্তব্য, স্ট্রোক-পরবর্তী এই অবসাদের জেরে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেন। কেউ আবার ওষুধ-সহ অন্যান্য ডাক্তারি পরামর্শ মেনে চলা ছেড়ে দেন। ফলে রোগ সারার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে শুরু করে।
আইসিএমআর-এর সমীক্ষা অনুযায়ী স্ট্রোকের রোগীদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ রোগে আক্রান্ত হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। আরও ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অবসাদটা আসে বেশ কিছুটা দেরিতে। আমেরিকান জার্নাল অব জেরিয়াট্রিক সাইকিয়াট্রিতে সম্প্রতি এই সমীক্ষা-রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে। সমীক্ষক দলের অন্যতম সদস্য, স্নায়ু চিকিৎসক শ্যামল দাস বলছেন, “যে রোগীদের অবসাদের চিকিৎসা হয় না, তাঁদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার প্রায় তিন গুণ বেশি। কিন্তু সমস্যা হল, ডাক্তাররা অনেকেই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেন না। শারীরিক সমস্যা থেকেই সাময়িক ভাবে মন খারাপ হচ্ছে ধরে নেন।”
স্ট্রোকের রোগীদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করা ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মৌলিমাধব ঘটক জানাচ্ছেন, স্ট্রোকের পরে রোগীকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানোর জন্য মস্তিষ্কের সুপ্ত কোষগুলিকে জাগিয়ে তোলা সব থেকে জরুরি। কিন্তু অবসাদ থাকলে সেই প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে। “আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, অবসাদের কারণে স্ট্রোকের রোগীরা স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। সেই কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলিতে সাইকো বিহেভিয়রাল থেরাপিস্ট-এর গুরুত্ব বাড়ছে।”
মনোবিদরাও মানছেন, স্ট্রোকের কারণে অবসাদের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সচেতনতা এখনও কম। মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “স্ট্রোকের রোগীরা যেমন অনেক বেশি অবসাদে আক্রান্ত হন, তেমনই অবসাদের রোগীদেরও স্ট্রোক হওয়ার ভয় বেশি। কারণ অবসাদের সময়ে শরীরে হরমোনের যে সব পরিবর্তন ঘটে, তাতে রক্ত জমাট বাঁধার
প্রবণতা বেড়ে যায়। স্ট্রোকের সঙ্গে অবসাদের এমন নিবিড় যোগাযোগের বিষয়টি ব্রিটিশ জার্নাল ল্যানসেট-এও প্রকাশিত হয়েছে।”
চিকিৎসকদের আক্ষেপ, স্ট্রোক সম্পর্কে এখনও সঠিক ভাবে অবহিত নন বহু মানুষ। এমনকী স্ট্রোক যে মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটাও অনেকে জানেন না। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। দিব্যি শক্ত-সমর্থ এক প্রৌঢ়ের মেয়ের বিয়ের দিন চারেক পর থেকে আচমকাই কথা সামান্য জড়িয়ে যেতে শুরু করে। সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছিলেন না। বাড়ির লোকেরা ধরে নিলেন, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন বলেই এমন হচ্ছে। পারিবারিক চিকিৎসককে ফোন করায় তিনি বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন। পর দিন অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে যেতে হল। ততক্ষণে প্রৌঢ়ের শরীরের একটা পাশ পুরো অসাড়। তখন জানা গেল, ২৪ ঘণ্টা আগেই তাঁর স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে।
কী হতে পারে স্ট্রোকের উপসর্গ? স্নায়ু চিকিৎসক দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, “আচমকা দুর্বলতা, খাবারের স্বাদ না পাওয়া, শরীরের কোনও অংশ হঠাৎই অসাড় লাগতে শুরু করলে, তা হতে পারের স্ট্রোকের পূর্বাভাস। হঠাৎ প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, হাঁটাচলায় অসুবিধা, কথা জড়িয়ে যাওয়াও স্ট্রোকের উপসর্গ হতে পারে।” অনেকেরই ধারণা স্ট্রোকের পরে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার জেরে অবসাদ হয়। চিকিৎসকরা ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বলছেন, মস্তিষ্কের ক্ষতি থেকেই ওই অবসাদের সৃষ্টি। তাই তার পৃথক চিকিৎসা হওয়াটা জরুরি। |