মোটরবাইকে চড়ে দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে নিজের দোকানে যাচ্ছিলেন এ-জোন অশোক অ্যাভিনিউয়ের বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়। মাঝ রাস্তায় হুটোপাটি করে সামনে এসে পড়ে এক দল কুকুর। মোটরবাইক থেকে পড়ে পা ভেঙে কয়েক মাস শয্যাশায়ী বিষ্ণুবাবু।
অফিস সেরে সন্ধ্যায় মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন অন্ডালের সঞ্জয় গিরি। ২ নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্গাপুরের মেনগেট এলাকায় আচমকা ধেয়ে এল কুকুর। মোটরবাইক রাস্তায় পাল্টি। সঞ্জয়বাবু বলেন, “ভাগ্য ভাল, সেই সময়ে পিছন থেকে কোনও গাড়ি আসছিল না। তাই বেঁচে গিয়েছি।”
দুর্গাপুরের রাস্তায় কুকুরের দৌরাত্ম্যে মাঝে-মধ্যেই এ ভাবে মুশকিলে পড়ছেন শহরবাসী। চার পা তুলে মোটরবাইকের সামনে এসে পড়লে পাল্টি তো খেতে হচ্ছেই, কখনও-সখনও জুটছে কামড়ও। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে কুকুরে কামড়ানোয় প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ জন হাসপাতালে এসেছিলেন। এ বছর সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৫-এ। |
রাস্তা জুড়ে। দুর্গাপুর সিটিসেন্টার এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র। |
সারা বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ১৮৮ জনকে কুকুরে কামড়েছিল। এ বছর জানুয়ারিতেই সেই সংখ্যা ছিল ২০২। গত বার কামড় খেয়েছিলেন মোট ১৫৬২ জন। এ বছর অগস্ট পর্যন্তই সেই সংখ্যা ১১৫১। হাসপাতাল সুপার দেবব্রত দাস বলেন, “দিন দিন কুকুরে কামড়ানোর হার যে ভাবে বাড়ছে, দুর্গাপুরের জন্য মোটেই ভাল খবর নয়।”
তবে কুকুরে কামড়ালে সকলে যে হাসপাতালে যান, এমন নয়। অনেকেই ডাক্তার দেখিয়ে বাজার থেকে হাজার দেড়েক টাকা খরচ করে প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন নিয়ে নেন। তাই কুকুরে কামড়ানোর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা বলা মুশকিল বলে দাবি হাসপাতালের। এমএএমসি টাউনশিপের বাসিন্দা সৌরভ রায়, বি-জোনের সৈকত দাস, বিধাননগরের তপন রায়েরা বলেন, “একে কামড় খাওয়ার ভয়। তার পরে হঠাৎ রাস্তা পাশের আগাছা থেকে কুকুর বেরিয়ে দ্রুত গতির মোটরবাইকের সামনে পড়লে পড়ে যাওয়ার ভয় তো আছেই।” তাঁরা জানান, চলন্ত গাড়ি, মোটরবাইকের সামনে পড়ে প্রাণ যাচ্ছে বহু কুকুরেরও।
শুধু দুর্গাপুর নয়, রানিগঞ্জ শহরেও কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে বলে পুরসভা সূত্রে খবর। সপ্তাহখানেকের মধ্যে রাস্তার কুকুর ২৬ জনকে কামড়েছে সেখানে। রানিগঞ্জের আলুগড়িয়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার পি কে চক্রবর্তী জানান, কুকুরের আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত প্রতিষেধক রাখা হয়েছে। প্রশাসনের তরফে বিষয়টি বন দফতরকেও জানানো হয়েছে।
বর্ধমান জেলায় দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজকর্ম করে। জখম কুকুরদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা থেকে নির্বীজকরণ, সব রকম কাজই করে বর্ধমান শহর ও পানাগড়ের সংস্থা দু’টি। দুর্গাপুরে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে পানাগড়ের ‘অস্তিত্ব’ নামে সংস্থাটি। সেটির সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় ‘অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড অফ ইন্ডিয়া’র আধিকারিক চন্দন গুঁই জানান, ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত দুর্গাপুরে রাস্তার কুকুরের সংখ্যা ছিল ১৮,৭৬৬টি। তাঁর অনুমান, “এ বছরের শেষে সেই সংখ্যা পৌঁছবে প্রায় ২৫ হাজারে।”
ওই সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে একটি কুকুরের নির্বীজকরণের মোট খরচ ১২০০-১৩০০ টাকা। দুর্গাপুরের বিধাননগরের বেসরকারি ম্যানেজমেন্ট কলেজ ডিএসএমএস-এর সামাজিক উন্নয়ন খাতে দেওয়া টাকায় বছরে গড়ে সাড়ে চারশো কুকুরের নির্বীজকরণ হয়। চন্দনবাবু বলেন, “আর্থিক সমস্যার জন্য কাজ করা যায় না। ওই কলেজ কর্তৃপক্ষের মতো যদি আরও অনেকে এগিয়ে আসেন তাহলে আরও বেশি হারে কুকুরের নির্বীজকরণের কাজ করা যেতে পারে।” তিনি জানান, এক মাত্র নির্বীজকরণই সমস্যার সমাধান করতে পারে। সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তখন জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ব্যাপারেও ভাবা সম্ভব।
দুর্গাপুরের মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায় জানান, হাজার হাজার কুকুরকে নির্বীজকরণ করতে গেলে প্রচুর টাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে আমরা ইতিমধ্যে কথাবার্তা বলেছি। টাকার অভাব একটি সমস্যা। কিন্তু কুকুরের উপদ্রবও দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু একটা বন্দোবস্ত করার চেষ্টা চলছে।” |