একে ছোট পর্দায় মুখ দেখানোর সুযোগ, সঙ্গে আবার হরেক দামি উপহারের প্রতিশ্রুতি! মাইক্রোওভেন থেকে সোনার গয়না, কী নেই!
মঙ্গলবার ভোররাত থেকেই লাইন পড়তে শুরু করেছিল। শহর ছাড়িয়ে সুদূর গ্রাম-মফস্বল থেকে উপচে পড়েছিল দিদি-বৌদিদের ভিড়! মায়েরাও পিছিয়ে ছিলেন না, বাচ্চাদের নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন লাইনে! দিনভর ঠায় দাঁড়ানোর পরে বিকেল গড়াতে কানে এল, অডিশন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে! রটে গেল, টাকা দিয়ে বেআইনি ভাবে আগেভাগে লোক ঢোকানো হয়েছে!
সারা দিনের উত্তেজনা-ক্লান্তিতে ধৈর্যের বাঁধটা ভেঙে গেল নিমেষে। রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মহিলারা। স্টুডিওর গেট ঝাঁকিয়ে ভাঙলেন। অডিশন রুম ভেঙে তছনছ করলেন। লাঠি দিয়ে দমাদ্দম ভাঙলেন একাধিক গাড়ি। বুধবার বিকেলের দমদম কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিল একটি টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় গেম শো-এর অডিশনকে ঘিরে। নামাতে হল র্যাফ। গণ্ডগোলের জেরে পদপিষ্ট হয়ে গুরুতর জখম হয়েছে দু’টি শিশু। আহত আরও চার জন। স্টুডিওর মধ্যে প্রোডাকশনের প্রায় ১০-১২ জন কর্মী দীর্ঘক্ষণ আটকে ছিলেন বলেও অভিযোগ।
ইদানীং হরেক কিসিমের টিভি শো সাধারণ মানুষের মনে যে ভাবে রাতারাতি সেলিব্রিটি হওয়ার বেপরোয়া বাসনা জাগাচ্ছে এবং ঢালাও পুরস্কারের হাতছানি যে ভাবে তাঁদের লালায়িত করছে, এ দিনের ঘটনা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল বলে মনে করছেন সমাজবিদরা। |
তখনও পুরোদমে চলছে বিক্ষোভ প্রদর্শন। দমদমে। —নিজস্ব চিত্র। |
দমদম থানার পূর্ব কমলাপুর এলাকার এইচএমভি স্টুডিওতে এ দিন সকাল থেকে অডিশন চলছিল। বেলা বাড়তেই লাইন স্টুডিওর তিন নম্বর গেট ছাড়িয়ে এক দিকে গোরাবাজার, অন্য দিকে এয়ারপোর্ট পেরিয়ে দমদমের বিভিন্ন গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ আচমকা রটে যায়, অডিশন এ বার বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখনই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের তরফে স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠানো রিপোর্টে জানানো হয়েছে, চ্যানেলের বেশ কিছু লোককে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে জনতা পুরোদস্তুর খেপে ওঠে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে প্রমীলা বাহিনী ছুটে যায় স্টুডিওর গেটে। ধাক্কা-মারামারিতে মাটিতে পড়ে যান অনেকে। বহু শিশু মায়ের হাত থেকে ছিটকে যায়। তাদের উপর দিয়ে মানুষ চলে যেতে থাকে। বালির বাসিন্দা বছর চল্লিশের সুস্মিতা রায় সকাল ন’টায় লাইন দিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ দুপুরের দিকে কানাকানি শুরু হয় যে, পাঁচশো-হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে গেটের পুলিশরা অনেককে আগে ঢোকাচ্ছে। “ভাবুন একবার! কত কষ্ট করে আমরা সবাই লাইন দিয়েছি, তার মধ্যে এই দু’নম্বরি। সবাই প্রতিবাদ করতে থাকি। বিষয়টা তখনকার মতো মেটে।” সুস্মিতা বলতে থাকেন, “সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হঠাৎ দেখি লাইন ভেঙে সবাই দৌড়চ্ছে। চারদিকে ভাঙচুর হচ্ছে। আমি পালিয়ে সেন্ট্রাল জেলের কাছে এসে একটা অটোয় উঠে পড়লাম।”
পুলিশ সূত্রের খবর, উন্মত্ত জনতা তত ক্ষণে স্টুডিও-র তিন নম্বর গেট খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভাঙা বাঁশের টুকরো নিয়ে ক্যামেরা, মনিটর, প্রজেক্টর, বড় এলসিডি টিভি-সহ বিভিন্ন জিনিস ভাঙতে শুরু করে। তছনছ হয়ে যায় মেকআপ রুম। স্টুডিও-র বাইরে এইচএমভির ৮টি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। স্টুডিওর সামনে হাতে গোনা কয়েক জন পুলিশ থাকলেও তাঁরা পরিস্থিতি সামলাতে পারেননি। পরে দমদম থানা থেকে আরও বাহিনী এলে ভাঙচুর করা হয় ওসির গাড়িও। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ কর্তারা দাবি করছেন, “চ্যানেল থেকে জানানোই হয়নি যে, এত সংখ্যক প্রতিযোগী আসতে পারেন। জানালে নিশ্চয়ই আরও পুলিশি নিরাপত্তা দিতাম।”
ওই চ্যানেলের বিজনেস হেড সুজয় কুট্টি অবশ্য অডিশন বন্ধ করে দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। টেলিফোনে তিনি বলেন, “ভাবতেও পারছি না এই রকম লজ্জাজনক ঘটনা ঘটতে পারে। এর আগে কোথাও এমন ঘটেনি। আমরা কখনও বলিনি যে, অডিশন বন্ধ করা হবে।” তাঁর বরং দাবি, “আমাদের কর্মীরা বারবার প্রতিযোগীদের বোঝান যে, যত রাতই হোক অডিশন চলবে এবং লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেকের খাবার ও জলের ব্যবস্থা করা হবে। তা সত্ত্বেও জনতা মারমুখী হয়ে ওঠে।”
টেলিভিশনে ক্ষণিকের মুখ দেখানো আর পুরস্কারের নেশাই কি মানুষকে এতটা আগ্রাসী করে তুলল? সমাজ মনস্তত্ত্ববিদ দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যাঁদের জীবনে সেই অর্থে সাফল্য বা নামযশ কম, তাঁরা দড়ির টানে পুতুলের মতো চলেন। আধ ঘণ্টা বা পনেরো মিনিটের মিডিয়া এক্সপোজার-ও তাঁদের কাছে অনেক। এক বার টিভিতে মুখ দেখানো মানে আগামী ছ’মাস পরিচিতদের আপনি বড় মুখ করে সেটা বলতে পারেন।” একই মত খড়্গপুর আইআইটি-র এক মনোবিদেরও। তাঁর কথায়, এই ধরনের শো-এ অংশ নেন মূলত গৃহবধূরা। আজকের এই দেখনদারি ও প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় যাঁরা আত্মপরিচিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হীনমন্যতায় ভোগেন। এর সঙ্গে মনোবিদরা যোগ করছেন ‘মাস হিস্ট্রিওনিক্স’ বা যৌথ আগ্রাসনের প্রসঙ্গটিও। অর্থাৎ, একই ধরনের আর্থসামাজিক-মানসিক গড়নের মানুষ এক জায়গায় ভিড় করলে অনেক সময় মুহূর্তের উত্তেজনায় তাঁরা অনেক কিছু করতে পারেন, যা একা থাকলে হয়তো তাঁরা করতেন না। |