এই সে পেরিয়ে গেল নাইজেরিয়া। ওদের সঙ্গে কী যেন অশান্তি শুরু হয়েছে। ভাবার সময় নেই, তত ক্ষণে সে চাদের উপর দিয়ে চলেছে। এর পর ভারত মহাসাগরের উপরে। না, নিজের দেশের উপর দিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে ভাবেই ছকা আছে তার যাত্রাপথ। লং জাম্প দিতে এখনও বাকি ২৪ দিন। তার আগে শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে ‘দাদা-দিদি’দের মতো পাক খেয়ে চলেছে ‘মম্’।
দাদা-দিদি বলতে ইসরোর পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহ ইনস্যাট, কল্পনা আগে থেকেই যারা পাক খেয়ে চলেছে পৃথিবীকে। আর মম্— মঙ্গলবার শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে রওনা দেওয়া মঙ্গলযান। মার্স অরবিটার মিশন (এমওএম) বা সংক্ষেপে মম্।
ইসরোর মুখপাত্র বি আর গুরুপ্রসাদ আজ বলেন, “উৎক্ষেপণ ঠিকঠাক হওয়ায় মঙ্গলযানকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করতে কোনও সমস্যাই হয়নি। উৎক্ষেপণের পর থেকেই পৃথিবীর কক্ষপথে পাক খাচ্ছে মম্। ইতিমধ্যেই এক বার ‘লিকুউড অ্যাপোজি মোটর ইঞ্জিন’ চালু করে তার শক্তি বাড়ানো হয়েছে। ২৪ দিনে ছ’বার পাক খাবে মহাকাশযান। তার পর ১ ডিসেম্বর মুক্তিবেগ (১২ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড) পেয়ে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল কাটিয়ে রওনা দেবে মহাকাশের গভীরে, মঙ্গলের পথে। সে পথও মোটেই নিরাপদ নয়। আসতে পারে বেশ কিছু বাধা বিপত্তি। উল্কা-গ্রহাণুর মতো আপদগুলিকে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে এগোতে হবে। অনেকটা ভিডিও গেমের মতো।
এখন কী অবস্থা মঙ্গলযানের?
ইসরো সূত্রের খবর, কাল রাতেই মেলে দেওয়া হয়েছে সৌরশক্তির প্যানেল বসানো ডানা। পিএসএলভি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় মঙ্গলযানের গতি ছিল সেকেন্ডে ৯ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই পাক খাওয়ার সময়ই ধীরে ধীরে গতি বাড়ানো হবে। বাড়বে কক্ষপথের উচ্চতা।
উৎক্ষেপণের পরে কাল স্বাভাবিক ভাবেই স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল ইসরো-কর্তাদের চোখেমুখে। তবে নয়নমণিকে এক মুহূর্তও নজরের আড়াল করছেন না কন্ট্রোল রুমে বসে থাকা বিজ্ঞানীরা। ইসরোর এক মুখপাত্র জানালেন, “যানটি মঙ্গলের কক্ষপথে না ঢোকা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।” কেন? ওই মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, আগে বিভিন্ন দেশের অভিযানে পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়ার আগেই যানের ক্ষতি হয়েছে। অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। তাই আগামী ২৪ দিন চুড়ান্ত সতর্ক রয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এক বিজ্ঞানী বলছেন, “পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়ার পরে প্রায় ৩০০ দিন ধরে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে যেতে হবে। তার গতিপথে সেই সময় আচমকা সৌরঝড় কিংবা উল্কা-গ্রহাণু চলে আসতে পারে। তা থেকেও সতর্ক থাকতে হবে।”
এই সব ঝঞ্ঝা সামলানোর জন্য বিজ্ঞানীদের বিশেষ দল ‘কন্টিনজেন্সি ম্যানেজমেন্ট টিম’ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, তার কিছুটা প্রোগ্রাম করা রয়েছে মহাকাশযানের মগজেও। “তবে এ সব কাটিয়েও মঙ্গলের কক্ষপথে ভারতের দূতকে ঠিক মতো স্থাপন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ,” বলছেন অভিযানের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সুব্বাইয়া অরুণান।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানান, যে গতিতে মহাকাশ পাড়ি দেবে মঙ্গলযান, লাল গ্রহের কক্ষপথে ঢোকার আগে তা কমিয়ে ফেলতে হবে। মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশের আগে গতি থাকবে সেকেন্ডে ১.১১ কিলোমিটার মতো। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, মঙ্গলের নিজস্ব অভিকর্ষ বল রয়েছে। গতি না কমালে মঙ্গলের মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে যান। আবার লাল গ্রহের পাশ কাটিয়ে বেরিয়েও যেতে পারে। গতি কমাতে তাই শেষ মুহূর্তে যানের মুখ ঘুরিয়ে দিতে ইঞ্জিন চালু করাতে হতে পারে। ইসরোর এক কর্তার কথায়, “শেষ মুহূর্তের ফায়ারিংয়ে সামান্য ভুলচুকও অভিযান ব্যর্থ করে দিতে পারে।”
উৎক্ষেপণের পরেও তাই উৎকন্ঠার প্রহর গুনছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের চিন্তা ৪৫০ কোটি টাকা খরচ করে এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে। মম্কে ঘিরে অন্য চিন্তা প্রতিবেশী চিনের। প্রথম বারে সাফল্য পেলে ভারতই হবে মঙ্গল যাত্রায় সফল এশিয়ার প্রথম দেশ। ভারত টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলে চিনকেও প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিল চিনের সংবাদমাধ্যম। আজ কিন্তু চিনে উল্টো মতও উঠে এসেছে। তা হল, নিজেদের স্বপ্ন, প্রয়োজন ও পরিকল্পনা অনুযায়ীই এগোনো উচিত বেজিংয়ের। তবু প্রতিযোগীসুলভ ভাবনা থেকেই চিন মনে করাচ্ছে, ভারত কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে নিজেকে। চিনের মহাকাশ প্রযুক্তি অ্যাকাডেমির গবেষক প্যাং ঝিহাউ-এর কথায়, “উৎক্ষেপণ তো এক বছর ব্যাপী অভিযানের শুরু মাত্র। মম্-কে মঙ্গলের কক্ষপথে স্থাপন করাটা অনেকটা টোকিও থেকে গলফ বল মেরে প্যারিসের কোনও গর্তে সেঁধিয়ে দেওয়ার মতো।”
|