পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক!
উত্ক্ষেপণস্থল থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে মিডিয়া সেন্টারটা থরথর করে কেঁপে উঠল। ছাপার ভুল নয়, ৭ কিলোমিটারই। চোখের সামনে দেখলাম, আগুন ছড়িয়ে সাঁ সাঁ করে উঠে যাচ্ছে ৪৪ মিটার লম্বা রকেটটা। পিছনে শুনতে পাচ্ছি সহ-সাংবাদিকদের হাততালি। কারণটা সহজবোধ্য। শুধু ‘মঙ্গলযান’ তো নয়, ওই রকেটে চেপে ভারতও পৌঁছে গেল মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক বিরলতম উচ্চতায়। এত দিন মঙ্গলে সফল অভিযান চালাতে পেরেছে শুধু আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এ বার সেই পথে প্রথম ধাপটা পেরিয়ে গেল আর্যভট্ট-বরাহমিহিরের দেশ। বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছেন, পিএসএলভি রকেট নির্বিঘ্নেই পৃথিবীর চার ধারের কক্ষপথে পৌঁছে দিয়েছে মঙ্গলযানকে। সপ্তাহ তিনেক পর শুরু হবে তার মঙ্গলের দিকে যাত্রা।
সতীশ ধবন মহাকাশ কেন্দ্রের মিডিয়া সেন্টারেই প্রথমে বসেছিলাম আমরা। সামনের বিরাট স্ক্রিনে কখনও দেখাচ্ছে অপেক্ষমান রকেটটাকে, কখনও মিশন কন্ট্রোলে বসা বিজ্ঞানীদের থমথমে মুখ। ইসরো চেয়ারম্যান কে রাধাকৃষ্ণন গম্ভীর। লাউডস্পিকার থেকে মাঝেমধ্যে ছিটকে আসছে একটা-দু’টো শব্দ ‘সফটওয়্যার ডাউনলোডিং’, ‘সফটওয়্যার চেকিং’। আর থেকে থেকে ঘোষণা, কত মিনিট বাকি।
মিনিট পাঁচেক বাকি থাকতে উঠে পড়লাম। ইসরো-কর্তা, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিক মিলিয়ে একটা ছোটখাটো দল পৌঁছে গেলাম মিডিয়া সেন্টারের ছাদে। যাতে যতটা সম্ভব ভাল করে দেখা যায়। ছাদেও লাউডস্পিকার। কাজেই সময়ের হিসেবটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। দু-এক জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও লাভ হল না। টেনশনে এক জন বিড়বিড় করলেন, “এ বারের ব্যাপারটা তো একেবারেই আলাদা!”
তার পর এক সময়ে এল সেই মুহূর্তটাও। পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক! ক’টা বেজেছে জানি। দুপুর ২টো ৩৮।
অত হাততালি-উচ্ছ্বাসের মধ্যেও পাশে দাঁড়ানো ইসরোর বাঙালি কর্তা চুপ। বললেন, “সবে উত্ক্ষেপণ হয়েছে। কিন্তু ঠিক মতো হয়েছে কি না, বুঝতে অন্তত ৪৫ মিনিট লাগবে।” আসলে মহাকাশযান মাটি ছাড়া মানেই যে গোটা ব্যাপারটা সফল, এমন নয়। এর পর নির্দিষ্ট ব্যবধানে রকেটের এক-একটা অংশ আলাদা হতে থাকে। সর্বশেষ অংশটা আলাদা হয় যানকে কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়ার পর। |

উত্ক্ষেপণের মুহূর্তে। ছবি: পিটিআই। |
সেটাও হয়ে গেল মসৃণ ভাবে। ব্যাপারটা বুঝতে অবশ্য মিডিয়া সেন্টারের স্ক্রিনের সামনে ফিরে আসতে হয়েছিল। সেখানে বসে ক্রমশ জানা গেল, উত্ক্ষেপণের ১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের মাথায় রকেটের প্রথম অংশটা আলাদা হয়ে গিয়েছে। ৪ মিনিট ও ৯ মিনিটের মাথায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ। ৪৫ মিনিটে চতুর্থ তথা শেষ অংশ। তার পরেই আবার স্ক্রিনে রাধাকৃষ্ণন-সহ অন্য কর্তাদের মুখ। স্বভাবতই তৃপ্ত। পরে সাংবাদিক বৈঠকে এসে ইসরো চেয়ারম্যান বললেন, “উত্ক্ষেপণ সফল হয়েছে। তবে প্রথম দিকটা খুব টেনশনে কেটেছে।” ইতিমধ্যে অবশ্য মিডিয়া সেন্টারে হাজির বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মোবাইল বেজে উঠেছে। আঁচ করা গেল, শুভেচ্ছাবার্তা।
আজ ছিল পিএসএলভি-র ২৫তম উত্ক্ষেপণ। রজত জয়ন্তীতেই এমন সাফল্যে খুশি মিশন ডিরেক্টর কুনি কৃষ্ণন। বললেন, “পিএসএলভি মহাকাশযানকে একদম ঠিকঠাক জায়গায় স্থাপন করেছে।” এ দিন আবহাওয়াও ছিল অনুকূলে। আসলে, এই অভিযানে ইসরোর বড় চিন্তা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের আবহাওয়া। প্রথমে রওনার দিন ঠিক ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকলে যানের নির্দিষ্ট গতিপথ থেকে সরে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকেই। তা ছাড়া, মঙ্গলযানে নজরদারির জন্যই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নোঙর করে রয়েছে ‘নালন্দা’ ও ‘যমুনা’ নামে দু’টো জাহাজ। ওই দুই জাহাজ আসলে দু’টি ভাসমান অবজারভেটরি। সেখানে রয়েছেন দু’দল বিজ্ঞানী। সেপ্টেম্বরে খারাপ আবহাওয়ার জন্য ওই জাহাজ দু’টিরও রওনা হতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। সব দিক দেখে তাই পিছিয়ে আনতে হয়েছিল উত্ক্ষেপণ। আজ চূড়ান্ত স্বস্তিদায়ক বার্তাটা যমুনা জাহাজ থেকেই এসেছে। মঙ্গলযানকে কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে রকেটের শেষ অংশের আলাদা হয়ে যাওয়ার খবর এসেছে সেখান থেকেই। বলতে গেলে তখনই হাঁফ ছেড়েছে মিশন কন্ট্রোল।
শ্রীহরিকোটায় আজ হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি পুলক চট্টোপাধ্যায়। পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ নিজেও ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাধাকৃষ্ণনকে। যদিও লক্ষ্যপূরণ হয়ে গিয়েছে এমন দাবি স্বভাবতই করলেন না কোনও বিজ্ঞানী। বরং বারবার মনে করিয়ে দিলেন, একটা কঠিন ধাপ সবেমাত্র পেরোনো গেল। মঙ্গল এখনও অনেক দূর।
তাঁরা বোঝালেন, মহাকাশযানটি সবে পৃথিবীর চারপাশে কক্ষপথে স্থাপিত হয়েছে। এ বার মুক্তিবেগ পেতে পৃথিবীকে ছ’বার পাক খাবে সে। ব্যাপারটা অনেকটা লং জাম্পের আগের দৌড়ের মতো। মঙ্গলযান পাক খেয়ে চলবে, দরকার মতো তার ‘লিকুইড অ্যাপোজি মোটর ইঞ্জিন’ চালু করে সেটির গতিবেগ বাড়িয়ে তোলা হবে। শেষ পর্যন্ত তার গতিবেগ দাঁড়াবে সেকেন্ডে ১২ কিলোমিটার। সেটাই তার মুক্তিবেগ। অর্থাত্ ওই গতিবেগে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টান কাটিয়ে ফেলবে মঙ্গলযান। তখন তাকে রওনা করে দেওয়া হবে মঙ্গলের দিকে।
কেন ১ ডিসেম্বর? তার আগে নয় কেন? এক বিজ্ঞানী বোঝালেন, “পুরো অভিযানের গতিপথ যে ভাবে হিসেব করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী মঙ্গলযানকে ওই দিনই কক্ষপথের বাইরে পাঠাতে হবে, তার আগে নয়।” এবং সেই হিসেব মেনেই ২০১৪-র ২১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করবে যানটি। |
ঐতিহাসিক 
শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র থেকে লাল গ্রহে
পাড়ি দিল
ভারতের প্রথম মঙ্গলযান। মঙ্গলবার দুপুরে দুবরাজপুরে
টিভির পর্দায় তারই সাক্ষী থাকা। —নিজস্ব চিত্র। |
রাধাকৃষ্ণন জানালেন, মঙ্গলের চারপাশের কক্ষপথে মঙ্গলযানকে স্থাপন করাটাও আর এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ, যানটি যখন পৃথিবীর টান কাটিয়ে লাল গ্রহের আকর্ষণের আওতায় চলে আসবে, তখন দেখতে হবে সে যেন মঙ্গলের মাটিতে গিয়ে আছড়ে না পড়ে। তা হলে কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই জলে যাবে। কারণ, মঙ্গলের চারদিকে ক্রমাগত চক্কর কেটে তাকে খুঁজতে হবে মিথেন। সেই সঙ্গে লাল গ্রহ থেকে জল হারিয়ে যাওয়ার কারণও। খতিয়ে দেখতে হবে মাটির গঠন। কত দিন ধরে এই টহলদারি চলবে, ঠিক হয়নি। কাজেই খুব যত্নেই তাকে বসানো হবে ওই কক্ষপথে। ইসরোর এক সূত্র জানালেন, এর জন্য মঙ্গলের কাছে গিয়ে যানটির গতি অনেকটা কমিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে পাল্টা অভিঘাত তৈরি করতে তার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে চালু করে দেওয়া হবে ইঞ্জিন। গতিতে গড়বড় হলে মঙ্গলকে টপকে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তো থাকছে।
কিন্তু সে সবেরও এখনও প্রায় ৩০০ দিন বাকি। এই সময়টা ইসরোর কাছে কার্যত যুদ্ধ পরিস্থিতি। মঙ্গলযাত্রা নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি এই ক’দিনে অন্য এক চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হয়েছে ইসরোকে প্রশ্নবাণ, সংশয়।
সংশয়ীদের তালিকায় উজ্জ্বলতম নাম ইসরোরই প্রাক্তন প্রধান জি মাধবন নায়ার-এর। মঙ্গলযাত্রার তোড়জোড় শুরু যাঁর আমলে। আজ চোখে পড়ার মতো ছিল যাঁর অনুপস্থিতি। দিন কয়েক আগে সেই মাধবন বলেছিলেন, স্রেফ মহাকাশ দৌড়ে সামিল হওয়ার জন্যই দরকারের চেয়ে অনেক কম যন্ত্রপাতি-সহ, কম শক্তিশালী রকেটে তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে মঙ্গলযানকে। এ প্রশ্নও উঠেছিল, বহু কল্যাণমূলক প্রকল্প মুলতুবি রেখে সাড়ে চারশো কোটি টাকার মঙ্গলযাত্রা কেন?
আজ সাংবাদিক সম্মেলনেও সেই প্রশ্নের মুখে রাধাকৃষ্ণন। সেখানে আবার অন্ধ্রের একদল সাংবাদিক তেলঙ্গানা-বিরোধী প্ল্যাকার্ড তুলে ধরলেন। পরে রাধাকৃষ্ণন বললেন, “ইসরোর পুরো টিমকে ধন্যবাদ। কোনও অভিযানই আর আমাদের অসাধ্য নয়!” |