কয়েক বছর আগেও নিয়মিত বা স্থায়ী কাজের আর্জি নিয়ে প্রশাসনের কর্তাদের দোরে দোরে ঘুরেছেন। ফি বছর পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবি জানাতে গিয়েও কম কথা শোনেননি রাসমেলার রাসচক্র তৈরির কারিগর আলতাফ মিঁয়া। তিতিবিরক্ত আলতাফ এখন বাড়তি মজুরি ছাড়াই রাসচক্র তৈরির কথা ভাবেন। তাঁর কথায়, “বাড়তি মজুরির কথা আর ভাবি না। উদ্যোক্তারা ভাববেন।” কোচবিহারের জেলাশাসক তথা দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি মোহন গাঁধী বলেন, “কিছু দিন আগেই বোর্ডের আওতাধীন সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের নূনতম বেতন বাড়িয়ে মাসে ৫ হাজার টাকা হয়েছে। আলতাফ মিঁয়া সেই তালিকায় আছেন। চাইলে মূল্যবৃদ্ধির জন্য রাসচক্রের বাড়তি খরচ দেওয়ার বিষয়টিও ভাবা হবে। তবে স্থায়ী চাকরির ব্যাপারে তো কিছু পদ্ধতি মানতে হয়।”
দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৮১২ সালে ভেটাগুড়িতে রাসমেলার সূচনা করেন কোচবিহারের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। ১৮৯০ সালে বৈরাগি দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় বসছে কোচবিহার রাসমেলা। ওই রাসমেলার মূল আকর্ষণ রাসচক্র। রীতি মেনে ফি বছর ওই রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের উদ্বোধন হয়। |
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ রাসচক্র ঘুরিয়ে ওই দায়িত্ব সামলেছেন। এখন দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি তথা কোচবিহার জেলাশাসক পুরোহিতের পাশে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজোয় বসেন। রাসচক্র ঘুরিয়ে উসবের সূচনা করেন। রাসচক্র ঘুরিয়ে পূণ্য অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না কেউ। তাই প্রথম দিন থেকে রাসচক্র ঘোরাতে ভিড় উপচে পড়ে। বংশানুক্রমিকভাবে রাসচক্র তৈরির কাজ করছেন শহর লাগোয়া হরিণচওড়া এলাকার বাসিন্দা আলতাফ মিঁয়া। যাঁর বাড়ি আর তোর্সা নদীর মাঝে ব্যবধান বলতে বালির চরের সামান্য এলাকা। লক্ষ্মী পুজোর পর দিন থেকে দিনভর ওই রাসচক্র তৈরির কাজে মগ্ন আলতাফ। কখনও ছেলে আমিনুর কখনও বা স্ত্রী আর্জিনা বিবি তার সহযোগী। গত বছর রাসচক্র গড়ার খরচ ও পারিশ্রমিক মিলিয়ে তিনি পেয়েছিলেন সাত হাজার টাকা। এ বার কাগজ-বাঁশ-রঙ সবেরই দাম বেড়েছে। তার পরেও বাড়তি টাকা দাবির পুরানো আকচাআকচিতে যেতে চান না আলতাফ। বাড়ির দাওয়ায় বসে কাজের ফাঁকে আলতাফ মিঁয়া বলেন, “দেবোত্তর কর্তারা আমার জন্য অনেক করেছেন। রানি বাগানে রাত পাহারার অস্থায়ী কাজ দিয়েছেন। তাতে মাসে তিন হাজার টাকা পাই। টুকটাক দিনমজুরি করে চলে যায়। দুবেলা নুন-ভাতের চিন্তা নেই। তাই খরচ বাড়লেও বাড়তি টাকা চাইব না। ওরা নিজে থেকে নিশ্চয়ই ভাববেন।”
ফি বছর যিনি বাড়তি পারিশ্রমিক আর মাস মাইনের একটা কাজের দাবি জানাতেন, সেই আলতাফের কথা শুনে অবাক দেবোত্তর কর্তারাও। আরও এক ধাপ এগিয়ে আলতাফ অবশ্য বলছেন “একসময় আমার দাদু পরে বাবা রাসচক্র গড়েছেন। আমি এটা করছি তাও প্রায় তিরিশ বছর তো হবেই। এখন আর টাকা নিয়ে দর করতে ভাল লাগে না। বরং একেবারে নিখরচায় রাসচক্রটা গড়ে দেবার স্বপ্ন দেখি। স্থায়ী কিছু একটা কাজ হলে নিজেই প্রতি বছর টাকা খরচ করে রাসচক্রটা গড়ে দিতাম। কিন্তু সে সাধ্য এখন নেই।” এ কথা বলে ফের কাজে ডুবে যান আলতাফ। |