প্রবন্ধ ২...
অপরাধী, আমলা, রাজনীতিকের দুষ্টচক্র
০০৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউ এন ডি পি দুর্নীতি বিষয়ক একটি প্রাইমার প্রকাশ করে। সেই নথিতে দুর্নীতির বর্গীকরণ করা হয়েছিল। সেই তালিকাটি এই রকম। ‘ঘুষ’ মানে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে টাকা, পরিষেবা বা অন্য কোনও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ‘জালিয়াতি’ মানে কোনও অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ভ্রান্ত বা মিথ্যা তথ্য পেশ করা। ‘মানি লন্ডারিং’ মানে কালো টাকা সাদা করা— অন্যায় পথে অর্জিত অর্থকে এক খাত থেকে অন্য খাতে পাঠিয়ে তাকে আইনি করে তোলা। ‘এক্সটর্শন’ মানে তোলাবাজি— ভয় দেখিয়ে বা জুলুম করে অন্যায্য ভাবে টাকা, সম্পত্তি বা কোনও গোপন তথ্য আদায় করা। ‘কিকব্যাক’ হল বখরা, অন্যায় ভাবে কিছু টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেই টাকার একটা হিস্যা পাওয়া। ‘প্রভাব খাটানো’ মানে নিজের অবস্থানগত প্রতিপত্তির সুযোগ নিয়ে কাউকে কোনও অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ‘ক্রোনিজম’ বলতে বোঝায় নিজের বন্ধুবান্ধবদের, তাদের যোগ্যতার কথা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন সম্পদ বা কাজ বণ্টনের সময় বাড়তি সুবিধা করে দেওয়া। ‘নেপোটিজম’-ও অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, কিন্তু পরিবারের লোককে। ‘প্যাট্রোনেজ’ বা পৃষ্ঠপোষকতা হল কোনও ধনী বা প্রভাবশালী মানুষের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পারা। কোনও দায়িত্ব পালনের সময় কোনও গোপন তথ্য জানতে পেরে পরে সেই তথ্যকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করার কাজটিকে বলে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’। সরকারি লালফিতের ফাঁস আলগা করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার নাম ‘স্পিড মানি’। পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে কোনও কাজের জন্য বরাদ্দ টাকার অধিকার হাতে পেয়ে তাকে আত্মসাৎ করা হল ‘তহবিল তছরুপ’।
রীতিমত দীর্ঘ তালিকা, সংশয় নেই। স্বাভাবিক ভাবেই, এ রকম কোনও বর্গীকরণ সম্পূর্ণ নিখুঁত হতে পারে না। এক গোত্রের অন্তর্ভুক্ত দুর্নীতি বহু ক্ষেত্রেই অন্য গোত্রে ঢুকে পড়তে পারে। দুর্নীতিকে মোটের ওপর দু’ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায় বড় এবং খুচরো। বড় দুর্নীতিতে রাজনীতিকরা যুক্ত, নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। এই দুর্নীতির প্রভাব পড়ে দেশের নীতির ওপর যেমন, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের নীতি। আজ ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমা হয়েছে, তা মূলত এই গোত্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই। অন্য দিকে, খুচরো দুর্নীতি মাপে ছোট। সরকারি দফতরে আমলাদের দুর্নীতি এই গোত্রে পড়ে। ইউ এন ডি পি-র বর্গীকরণের সংজ্ঞা ব্যবহার করে বললে, এক্সটর্শন, কিকব্যাক, প্যাট্রোনেজ, স্পিড মানি ইত্যাদি এই খুচরো দুর্নীতির অন্তর্গত। যেখানে সরকারি পরিষেবার প্রশ্ন থাকে, সেখানে এই গোত্রের দুর্নীতি দেখতে পাওয়া যায়।

চেনা দৃশ্য। পশ্চিমবঙ্গে ‘দুর্নীতি’ও প্রধানত খুচরো মাপের।
তবে, বড় এবং খুচরো দুর্নীতির মধ্যবর্তী বিভাজিকাটি অলঙ্ঘ্য নয়। এবং, সময়ের সঙ্গে দুর্নীতির ক্ষেত্রও বদলায়। এখন আর বাড়িতে টেলিফোন সংযোগ পেতে ঘুষ দিতে হয় না বটে, কিন্তু টেলিকম লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতি কমেনি। সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে অবশ্যই স্বচ্ছতর করা সম্ভব, কিন্তু সরকারি কাজে কর্তাদের নিজস্ব বিবেচনার অধিকার এবং তার সম্ভাব্য অপপ্রয়োগকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা নির্ধারণ করা কঠিন। বড় মাপের দুর্নীতির সঙ্গে আর একটি প্রশ্নের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ— নির্বাচনের সময় দলীয় ব্যয়ভার কী ভাবে বহন করা হবে? এই প্রসঙ্গে ভারতে নির্বাচনী সংস্কারের প্রশ্নটিও অপরিহার্য। গত দুই দশকে বেশ কয়েকটি কমিটি এই প্রশ্নটি বিবেচনা করেছে। আগ্রহী পাঠক ভোরা কমিটি রিপোর্ট (১৯৯৩) এবং দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট (২০০৮) দেখতে পারেন।
প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের পঞ্চম রিপোর্টে ভোরা কমিটি রিপোর্ট থেকে উদ্ধার করে বলা হয়েছে, ‘এই দেশে বিভিন্ন সংগঠিত ক্রাইম সিন্ডিকেট বা মাফিয়া গোড়ায় কোনও বড় শহরে স্থানীয় ভাবে কিছু খুচরো অপরাধ, যেমন চোলাই তৈরি, জুয়া, সাট্টা বা যৌনচক্র চালানোর মতো কাজ করে হাত পাকায়। বন্দর সংলগ্ন অঞ্চলে এই অপরাধের তালিকায় স্মাগলিং, বিদেশি পণ্যের অবৈধ বিক্রয় জাতীয় কাজ থাকে। তার পরের ধাপ ড্রাগ-ব্যবসা। বড় শহরে এই জাতীয় ক্রাইম সিন্ডিকেটের আয়ের একটা বড় উৎস জমি-বাড়ির ব্যবসা। তার মধ্যে গায়ের জোরে জমি-বাড়ি দখল যেমন আছে, তেমনই ভয় দেখিয়ে অতি কম দামে বাড়ি কিনে নেওয়াও আছে। এই ভাবে যখন হাতে যথেষ্ট টাকা আসে, তখন আরম্ভ হয় রাজনীতিক এবং আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ। এই সম্পর্কটি এক বার স্থাপিত হয়ে গেলে কার্যত শাস্তির কোনও ভয় ছাড়াই অপরাধমূলক কাজকর্মের বহর বাড়তে থাকে। নির্বাচনের সময় এই অপরাধ-চক্রের বাহুবল নেতাদের খুবই কাজে আসে।’ ঠিক এই কারণেই বড় আর খুচরো দুর্নীতিকে পৃথক করা মুশকিল।
দ্য সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু সমীক্ষা করেছে। খুচরো দুর্নীতি বিষয়ে তা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (ইন্ডিয়া)-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে করা ২০০৮ সালের ইন্ডিয়া করাপশন স্টাডি এমনই একটি সমীক্ষা। এটি মানুষের ধারণা-ভিত্তিক (পারসেপশন বেসড) সমীক্ষা ছিল। ১১টি গণপরিষেবা বেছে নেওয়া হয়েছিল সমীক্ষাটির জন্য— প্রাথমিক পরিষেবা (গণবণ্টন ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল), বিদ্যুৎ, জল এবং চাহিদা ভিত্তিক পরিষেবা (জমির অধিকার সংক্রান্ত নথি, বাসস্থান, অরণ্য, একশো দিনের কাজ, ব্যাঙ্কিং, পুলিশ (ট্রাফিক এবং অপরাধ, উভয় ক্ষেত্রেই)। এই ক্ষেত্রগুলি খুচরো দুর্নীতির আখড়া। এই এগারোটি ক্ষেত্রের মধ্যে, মানুষের ধারণায়, দুর্নীতির সিঁড়িতে পুলিশ পয়লা নম্বরে রয়েছে। ক্রমহ্রাসমান দুর্নীতির প্রাবল্যের হিসেবে তার পরে রয়েছে জমির অধিকার সংক্রান্ত নথি, বাসস্থান, জল সরবরাহ, একশো দিনের কাজ, অরণ্য, বিদ্যুৎ, ব্যাঙ্কিং এবং স্কুলশিক্ষা। যে রাজ্যগুলিতে দুর্নীতির পরিমাণ ‘বিপজ্জনক’, সেগুলি হল অসম, বিহার, জম্মু ও কাশ্মীর, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গোয়া এবং নাগাল্যান্ড। যে রাজ্যগুলি দুর্নীতিতে এর পরের ধাপে, অর্থাৎ যেখানে দুর্নীতির হার অতি চড়া, সেগুলি হল কর্নাটক, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, মেঘালয় ও সিকিম। যত রকম তালিকা হয়, পশ্চিমবঙ্গ তো কার্যত তার সব কটাতেই মাঝারি গোত্রে থাকে। দুর্নীতিও ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির হার ‘মাঝারি’।

দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতির শিক্ষক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.