প্রবন্ধ ১...
সর্দার পটেল: ইতিহাস এত সরল নয়
র্দার বল্লভভাই পটেলকে নিয়ে যা শুরু হয়েছে, তা একান্ত ভাবে নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। লালকৃষ্ণ আডবাণী ১১ অক্টোবর তাঁর ব্লগে ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনে সর্দার পটেলের অবদানের পাশাপাশি লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং ভি পি মেননের ভূমিকারও সপ্রংশস উল্লেখ করেছেন। এবং নেহরুর ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়েছেন। নেহরুর সঙ্গে সর্দার পটেলের বিরোধটিই ওই রচনার মূল বিষয়বস্তু। তাই মোদী যখন বলেন যে, প্রথম প্রধানমন্ত্রী পটেল হলে দেশের হাল অন্য রকম হত, মনে হয় তিনি নিজের কথাই বলেন না, বরং একটি সামগ্রিক চিত্রনাট্য নিজের মতো করে পরিবেশন করেন।
অথচ ইতিহাস নিয়ে এই খেলাটা যখন শুরু হয়েছে, সেই সময়ে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে মোহমুক্ত ভাবে দেখার পরিবর্তে অধুনা সদা বিভ্রান্ত কংগ্রেস দল পটেল কতটা কংগ্রেসি ছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কভূমিতে অবতীর্ণ। কংগ্রেসের এই অপ্রস্তুত দশা মূল খেলাটাকে খেলো করে দিচ্ছে।
সর্দার পটেলকে শুধুমাত্র স্বাধীনতার প্রাক্কালে বা অনতি-পরবর্তীতে রাজন্যবর্গ দ্বারা শাসিত রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির মহানায়ক হিসেবে ভাবলে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হবে। এই অনন্য রাজনীতিক ও জাতীয়তাবাদী নেতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন গাঁধীজির একান্ত অনুগামী। কংগ্রেসের যে নেতারা কথায় গাঁধীবাদী হয়েও কাজে ভিন্ন রূপ ধারণ করতেন, তাঁদের সঙ্গে পটেলের বিরোধ ছিল। কৃষক সত্যাগ্রহের নেতা থেকে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নায়ক— তাঁর এই যাত্রাপথে সত্য যেমন গাঁধীর অনুগমন, তেমনই নেহরুর সাহচর্য। পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই স্বাধীন দেশের হাল ধরেছিলেন নেহরু ও পটেল। পটেলের ভূমিকায় অভিনয় করে তাঁর মূল্যায়ন করা যাবে না।

সহনায়ক। জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই পটেল। কংগ্রেস অধিবেশন, জয়পুর, ১৯৪৮
মূল যে প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হচ্ছে, তা ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতিবিধান সংক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান অবদানটি ব্রিটিশদের। বহু শাসনতান্ত্রিক খণ্ডে বিভক্ত একটি ভূখণ্ডকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংহতি প্রদানের কাজটি ঔপনিবেশিক প্রসারের ফল। অত্যন্ত কৌশলে ওই কাজটি শুরু হয়েছিল মূলত ১৮৩৪-এর ‘দ্য ডকট্রিন অব ল্যাপ্স’-এর মাধ্যমে। উত্তরাধিকারীবিহীন বা অপটু রাজন্যবর্গের হাত থেকে তাঁদের রাজ্যের শাসনভার কেড়ে নেওয়ার ওই প্রকল্পটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক মোক্ষম চাল। লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-১৮৫৬) তাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর এক দশকের কার্যকালে ডালহৌসি ঝাঁসি, উদয়পুর এবং অবধ-সহ প্রায় একুশটি রাজন্যবর্গ-শাসিত রাজ্য দখল করেছিলেন। ব্রিটিশদের এই প্রয়াস সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য সাধনে ব্রিটিশদের ওই অন্যায় প্রয়াসকে অস্বীকার করি কী করে? ঐক্য সাধনের প্রয়াসে এমন অন্যায় আজও হয়।
কোম্পানির শাসনের পর সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে প্রায় ছ’শো রাজন্যবর্গ দ্বারা শাসিত রাজ্য নিজেদের অন্তর্গত কার্যবিধি পরিচালনা করত। কিন্তু তাদের উপর এক প্রকার সার্বভৌমত্ব ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার। এক প্রকার খণ্ডিত স্বাধীনতা ভোগ করলেও, এই রাজ্যগুলির মহারাজা বা নিজামরা অনেকেই ভয়ানক স্বৈরাচারী ছিলেন। আবার অনেকের বদান্যতায় এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ, স্যর আশুতোষ বা মদনমোহন মালব্য-সহ অনেক মহারথীই এই মহারাজা বা নিজামদের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন।
গোল বাধল অন্যত্র। ১৯৪৭-এ লর্ড মাউন্টব্যাটেন এ দেশে এসেছিলেন ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করতে। কিন্তু কী ভাবে তা করা যাবে? অনতিঅতীতে ক্যাবিনেট মিশন প্রকল্প প্রায় সম্পূর্ণই ভেস্তে গেছে। তিনি একটা কোর কমিটি তৈরি করলেন। তাঁর সচিব হলেন পটেল-ঘনিষ্ঠ আই সি এস ভি পি মেনন। মেননের ক্ষুরধার মেধা অনুধাবন করেছিল ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত। লর্ড ওয়াভেল-এর পছন্দের আমলা মেনন ১৯৪৭-এর ১০ মে মাউন্টব্যাটেন, নেহরু ও পটেলের সামনে তাঁর পরিকল্পনা পেশ করলেন। সেই সূত্র ধরেই নির্মিত হয়েছিল ৩ জুন-এর মাউন্টব্যাটেন প্রকল্প এবং ১৮ জুলাই ব্রিটেনে পাশ হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন। ওই আইন একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও দেশভাগ ঘোষণা করেছিল, সঙ্গে ঘোষিত হয়েছিল রাজন্যবর্গ দ্বারা শাসিত রাজ্যগুলির স্বাধীনতা।
১৫ অগস্ট, ১৯৪৭-এর মধ্যে ওই রাজ্যগুলির একটা ব্যবস্থা করতেই হত মাউন্টব্যাটেনকে। দেশের মধ্যে স্বাধীন দেশ অবাস্তব। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য সাধনই ছিল নিয়তি। নেহরু ব্যস্ত সংবিধান প্রণয়নের কাজে। স্বরাষ্ট্র তথা উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার পটেল ভি পি মেনন ও মাউন্টব্যাটেনের সহায়তায় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কাজে নামলেন। ব্রিটিশ সরকার ওই রাজ্যগুলিকে করদাতা বা করদ রাজ্যে পরিণত করে হাঁটু ভেঙে দিয়েছিল। বাকি কাজটুকু করতে স্বাধীন ভারতীয় সরকারের বেশি সময় লাগেনি। ব্রিটিশ সরকারের অন্তিম লগ্নে তিনটি রাজ্য ছাড়া সবাই মেনন প্রবর্তিত ভারতভুক্তির সনদে সই করে দেন। মনে রাখা ভাল যে, ওই স্বাক্ষরগুলি প্রায় চা-এর টেবিলেই হয়েছিল। এই কাজের কৃতিত্ব একা সর্দার পটেলকে দিলে বড় ভুল হয়।
সমস্যা তৈরি করলেন তিন নৃপতি। জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহ, হায়দরাবাদের নিজাম ওসমান আলি খান ও জুনাগঢ়-এর নবাব তৃতীয় মুহাম্মদ মোহতাব খানজি। জুনাগঢ়ের ভারতভুক্তি কার্যকর করতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তুলনায় বড় সমস্যা হল নিজামের হায়দরাবাদ নিয়ে। সেই সমস্যার সমাধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পটেলের ভূমিকা স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পাশাপাশি, ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিজামের সঙ্গে বোঝাপড়ার কাজে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন গণপরিষদের বিশিষ্ট সদস্য কে এম মুনশি। প্রসঙ্গত, মোদী যা-ই বলুন, মনে রাখা দরকার, সোমনাথ মন্দির পুনর্গঠনের মূল কান্ডারি পটেল নন, এই কে এম মুনশি।
তিন নম্বর সমস্যার নাম জম্মু ও কাশ্মীর। সেই ইতিহাস বহুচর্চিত। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। মহারাজা হরি সিংহ যখন নেহরু ও মাউন্টব্যাটেনের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও ভারতে যোগ দিচ্ছেন না এবং, আশ্চর্যজনক ভাবে, ১৯৪৭-এর মে মাসে জন্মু ও কাশ্মীর রাজ্য হিন্দু সভা হরি সিংহ-র অবস্থানকে সমর্থন জানাচ্ছে, তখন নেহরু সর্দার পটেলকে একাধিক চিঠিতে জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে সওয়াল করলেন। অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন তাঁর মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন গ্রন্থে উল্লেখ করছেন: The States Ministry, under Sardar Vallabhbhai Patel’s direction, went out of its way to take no action which could be interpreted as forcing Kashmir’s hand and to give assurance that accession to Pakistan would not be taken amiss by India. কথাগুলো স্বয়ং মাউন্টব্যাটেনের। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, কাশ্মীর প্রশ্নে সর্দার পটেলের ভূমিকা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে হরি সিংহ আগে রাজি হতেন কি না বলা যায় না।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সংহতির কাজ তখনও বাকি ছিল। পটেল ১৯৫০-এ গত হওয়ার পর সে দায়িত্ব ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হয়। লড়াই চালাতে হয় ফরাসি ও পর্তুগিজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে। ফরাসিরা তুলনায় সহজ। যদিও পুদুচ্চেরিকে ভারতভুক্ত করতে নেহরুকে ১৯৫৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পুরো প্রক্রিয়ায় ফরাসি সরকারের অনুমোদন পেতে ১৯৬২ এসে যায়। তুলনায় পর্তুগাল অনেক বেশি বেগ দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত গোয়াকে ভারতের অঙ্গীভূত করতে সেনা পাঠাতে হয়।
ঘটনা হল, পটেল ও নেহরু নিজের নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্যসাধন এবং গণতান্ত্রিককরণের কাজ চালিয়ে গেছেন। উভয়ের চিন্তনে বৈপরীত্য থাকলেও কেউ কারুর উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেননি। হায়দরাবাদে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে সেনা পাঠানো পটেল জরুরি মনে করেছিলেন। নেহরু বাধা দেননি। আবার, কাশ্মীর প্রশ্নে নেহরু ও শেখ আবদুল্লা দ্রুত ভারতভুক্তির পক্ষে থাকলেও পটেল কিন্তু অপেক্ষা করার পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকেই মনে করেন, স্বাধীনতার আগে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সম্পন্ন হলে পাক হানাদারদের অনেক আগেই আটকে দেওয়া যেত, জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যা আজকের আকার নিত না।
মোদীর পটেল নির্মাণে অনেক আরোপিত ইতিহাস যুক্ত হচ্ছে। এতে দোষের কিছু নেই। ভক্তরা তাঁদের আরাধ্যকে নিয়ে এটুকু করেই থাকেন। কিন্তু সমস্যা হয় যখন কেউ ভাবেন যে এটা মোদীর নিজস্ব প্রকল্প। ব্যাপারটা তা নয়। আসলে রামমন্দির দিয়ে আর যথেষ্ট মানুষকে টানা যাবে না। তাই মন্দিরের বদলে চাই শৌচাগার। আবার, ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন সফল করার সুযোগ কোনও ঘোষিত হিন্দুত্ববাদীর হয়নি। এই প্রেক্ষিতে নেহরু-পটেলের মধ্যে নেহরু ঘোষিত শত্রু। অতএব সর্দার পটেল। অখণ্ড ভারতের বাকি কাজটুকু মোদী করতে চান। ভারতভুক্তির শর্ত হিসেবে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে নেহরু-পটেল একমত। তৎকালীন হরি সিংহ অনুগামী হিন্দুত্ববাদীরাও রাজি। সংবিধানের ৩৭০ ধারায় জম্মু ও কাশ্মীর সেই মর্যাদা পেল। জনসংঘ গঠনের পর থেকে হিন্দুত্ববাদীরা সেই ধারা বিলোপের দাবি করলেন। পরে তা-ই হল বিজেপির অন্যতম প্রধান দাবি। এই সম্ভাবনা তাই অবাস্তব নয় যে, অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখিয়ে মোদী যে পটেল সাজতে চাইছেন, তা এই জন্য যে, সুযোগ পেলে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে তিনি কাশ্মীরের সম্পূর্ণ ভারতভুক্তি ঘটাবেন। পারুন বা না-পারুন, এই স্বপ্ন দেখিয়ে ভোটের বাজার দখল করা যায় কি না, সেটাই দেখার।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.