পরিবহণ ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)-র কিছু ডিপোর বাড়তি জমি ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিকল্পনাটিকে সুসংহত রূপ দিতে এ বার সরকারি পাঁচটি পরিবহণ নিগমেরই যাবতীয় অতিরিক্ত জমিকে আলাদা করে বাইরে বার করে আনার প্রয়াস শুরু করে দিল রাজ্য সরকার। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে স্থির হয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় একটাই ডিপো রাখা হবে, যেখানে ঠাঁই হবে নিগম-নির্বিশেষে সমস্ত বাসের। এর ফলে অন্য যে সব ডিপো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে, সেগুলিকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের কথা ভাবা হয়েছে বলে রাজ্য পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর।
কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ (সিএসটিসি), উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ (এনবিএসটিসি), দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ (এসবিএসটিসি), পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহণ (ডব্লিউবিএসটিসি) এবং সিটিসি রাজ্য সরকারের এই পাঁচটি পরিবহণ নিগম বহু দিন ধরে ধুঁকছে। জ্বালানি-যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাত্রী-ভাড়া বাড়েনি, উপরন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বসে গিয়েছে বিস্তর বাস। তার উপরে রয়েছে অতিরিক্ত কর্মীর বিপুল বোঝা। সব মিলিয়ে ব্যয় যত, আয় সে তুলনায় কিছুই নয়। ফলে লোকসানোর ভারে নিগমগুলি দিন দিন ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের বড় ভরসা সরকারের জোগানো ভর্তুকি।
কিন্তু এখন রাজ্য চাইছে ভর্তুকির খুঁটি সরিয়ে নিতে। প্রতিটি নিগমকে বলে দেওয়া হয়েছে, তাদের এ বার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই উদ্যোগেরই অঙ্গ হিসেবে যেমন অতিরিক্ত কর্মীর বোঝা লাঘব করার চেষ্টা, তেমন জোর দেওয়া হচ্ছে উদ্বৃত্ত জমির বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে আয় বাড়ানোয়। পরিবহণ দফতরের খবর, রুগ্ণ নিগমগুলোর আর্থিক হাল ফেরানোর সম্ভাবনা যাচাই করতে রাজ্য সরকার এক পরামর্শদাতা সংস্থাকে নিয়োগ করেছিল গত বছর। বছর খানেক সমীক্ষা চালিয়ে তারা রাজ্যকে রিপোর্ট দিয়েছে। সরকারি বাস চালানোর পরিচালনগত বিভিন্ন পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন একই এলাকায় বিভিন্ন নিগমের জন্য আলাদা আলাদা বাস ডিপো থাকবে, যদি একটাতেই কাজ চলে যায়? ব্যাপারটা তা হলে কী রকম দাঁড়াবে?
পরিবহণ দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “ধরা যাক, একই অঞ্চলে দু’টো নিগমের দু’টি ডিপো পাশাপাশি রয়েছে। অথচ দুই নিগম মিলিয়ে সেখান থেকে বাস যত চলে, তা অনায়াসে একটা ডিপো থেকেই চালানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটা ডিপোয় সব বাস এনে অন্যটা খালি করে দেওয়া হবে। তার ফাঁকা জমি বাণিজ্যিক কাজে লাগানো হবে।” এ প্রসঙ্গে হাওড়া স্টেশন চত্বরের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তিনি। ওখানে সিএসটিসি-র ডিপোটির কাছাকাছি রয়েছে এসবিএসটিসি-র গ্যারাজ। একই তল্লাটে সিটিসি-রও ডিপো। কিন্তু সব মিলিয়ে যত বাস চলে, তাতে তিনটের যে কোনও একটাই যথেষ্ট বলে কর্তাদের দাবি। একই ভাবে তাঁরা দেখেছেন, বেলঘরিয়ায় দু’টি পরিবহণ নিগমের ডিপোর মধ্যে একটা রাখলেই বাস চালানো যেতে পারে। অন্যটার জমি অনায়াসে উদ্বৃত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। “এমন আরও অনেক জায়গা আছে, যেখানে বহু উদ্বৃত্ত জমি মিলতে পারে। তবে এ জন্য সবার আগে দরকার পাঁচটি নিগমের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা।” মন্তব্য এক পরিবহণ-কর্তার।
বস্তুত বিভিন্ন পরিবহণ নিগমের মধ্যে সে ভাবে সমন্বয় না-থাকাতেই খাপছাড়া ভাবে একই জায়গায় একাধিক ডিপো গড়ে উঠেছে বলে আক্ষেপ করছেন দফতরের কর্তারা। এবং এর কিছুটা দায় যে খোদ পরিবহণ দফতরের উপরেও বর্তায়, অনেকে তা-ও অস্বীকার করেননি। তবে বোঝাপড়ার ঘাটতি দূর করতে এ বার রাজ্যের পরিবহণ-সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাথায় রেখে একটি কমিটি হয়েছে। ওই ‘কনফেডারাল কমিটি’তে রয়েছেন পাঁচ পরিবহণ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরেরা। উপরন্তু সরকারি সমস্ত বাস-রুট এবং অন্যান্য বিষয় খতিয়ে দেখতে নিগম-কর্তাদের নিয়ে গড়া হয়েছে টাস্ক ফোর্স। এদের কাজ কী হবে?
দফতরের খবর: নতুন কমিটি রাজ্যের সমস্ত সরকারি বাস-রুট পর্যালোচনা করবে। প্রয়োজনে রুট-বিন্যাস হবে নতুন করে। নজর থাকবে, যাতে একই রুটে একাধিক নিগমের বাস না-চলে। এতে রুটগুলিকে আর্থিক ভাবে লাভজনক করে তোলা যাবে বলে সরকারের আশা। এক কর্তার কথায়, “কোন রুটে কার বাস চলবে, পাঁচ নিগমের কর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তার তালিকা বানাবেন।” সব ক’টি নিগমকে এক সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা আছে?
কর্তাটি বলেন, “নিগম সংযুক্তিকরণের ভাবনা তো রয়েইছে। তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। তাই আপাতত দেখা হচ্ছে, বিভিন্ন নিগমের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে কী ভাবে আয় বাড়ানো যায়।” পরিবহণ-কর্তারা মনে করছেন, নিগমে-নিগমে বোঝাপড়া গড়ে উঠলে অযথা বাস ব্যবহারের ঝোঁক কমবে। পাশাপাশি সম্ভাব্য যাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী বাস চলাচলের সূচি তৈরি হলে সংশ্লিষ্ট নিগমের রোজগার বাড়বে। যদিও এ নিয়ে কিছু আশঙ্কা ইতিমধ্যে দানা বেঁধেছে পরিবহণ-কর্তাদের একাংশের মনে। তাঁদের বক্তব্য, “বিভিন্ন নিগমের কাজের ধরন ও প্রক্রিয়া বিভিন্ন। সংযুক্তিকরণ হলে আলাদা কথা। কিন্তু তার বদলে এ ভাবে সমন্বয় তৈরির চেষ্টা কতটা সফল হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।”
আর এ সব কিছুর উপরে থেকে যাচ্ছে ভাড়াবৃদ্ধির প্রশ্ন। তেল-যন্ত্রাংশের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি যাত্রী-ভাড়া না-বাড়ে, তা হলে আয়বৃদ্ধির উদ্যোগ সার্বিক ভাবে কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে সম্পর্কে সংশয় রয়েছে দফতরেরই অন্দরে। যা নিরসনের কোনও আশু ইঙ্গিত সরকারের তরফে মেলেনি। |