|
|
|
|
উপন্যাসের সূত্র ধরে জন্মভূমিতে ফিরলেন চিনের মিং-রা
নিজস্ব সংবাদদাতা • গুয়াহাটি |
পাঁচ দশক আগে ফেলে যাওয়া জন্মভূমি, শৈশবের বান্ধবীদের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল বাঁধ মানছিল না হো ইউয়েত মিং-এর। রাতভর ট্রেন যাত্রার পর, সকালে তিনিসুকিয়া স্টেশন। তারপর গাড়িতে মাকুম। ৫৮ বছরের প্রৌঢ়াকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন তাঁর শৈশবের বন্ধুরা। চারিদিক তখন আবেগের বন্যায় ভাসছে।
মিং একা নন, রীতা চৌধুরির উপন্যাসের সূত্র ধরে ৫০ বছর পরে অসমে পৌঁছলেন সেখানে জন্মগ্রহণ করা ৭ চিনা নাগরিক। যাঁদের বর্তমান নিবাস হংকং। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক চাপ, গুপ্তচরের অপবাদ নিয়ে পরিবার-সহ ভারত ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের সকলকেই।
তিনিসুকিয়ার শান্ত চা বাগান এলাকা মাকুম ছিল চিনেরই ছোট সংস্করণ। ১৮৩০ সাল থেকে উজানি অসমের লখিমপুর, ধেমাজি, ডিব্রুগড়, তিনিসুকিয়ার পাকাপাকি বাসিন্দা ছিলেন বহু চিনা পরিবার। ১৯ শতকের প্রথমদিকে চিনের চা চারাগাছ এনে অসমে বাগান তৈরির সময় ক্যান্টন, ম্যাকাও থেকে বাগানের শ্রমিক হিসেবে কয়েকজন যুবককে নিয়ে এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অসমীয়, বড়ো, রাভা ও অন্য উপজাতি মেয়েদের বিয়ে করে মনেপ্রাণে অসমীয় হয়ে যাওয়া ওই চিনাদের কপাল পুড়ল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর।
১৯৬২ সালের ১৯ নভেম্বর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অসমের হাজার-হাজার চিনা বাসিন্দাকে আটক করে ভারতীয় সেনা ও পুলিশ। একাংশকে পাঠানো হয় জেলে। বাকি প্রায় ১২০০ জনকে সীমান্তের ওপারে ফেরত পাঠানো হয়। পথেই মৃত্যু হয় অনেক বৃদ্ধের। যাঁরা চিনে পৌঁছলেন তাঁরা ‘ভারতীয় পূঁজিপতিদের দালাল’ তক্মা পেলেন। যাঁরা পরে অসমে ফেরেন, তাঁদের গুপ্তচর বদনাম গেল না। সব পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সরকার। চিনাদের অনেকেই ব্যবসা করে সফল হয়েছিলেন। কার্যত, উজানি অসমের তিন জেলায় শিল্পায়ন ঘটে চিনাদের হাত ধরেই। কিন্তু, যুদ্ধের পর সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান তাঁরা। এখন, মাকুমে মাত্র ৯টি চিনা পরিবার রয়েছে। অনেকে শিলং চলে গিয়েছেন।
সেই ইতিহাসকেই তাঁর উপন্যাস ‘মাকুম’-এ তুলে ধরেছিলেন কটন কলেজের অধ্যাপক রীতা চৌধুরি। ক্যান্টনি ভাষায় মাকুমের অর্থ---সোনার ঘোড়া। রীতাদেবী চিন, সিঙ্গপুর, হংকং, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার মাকুম প্রাক্তনিদের খুঁজে বের করেন। চিনে রীতাদেবীর সঙ্গে দেখা হয় মাইলিন হো’র। ২০ বছরের মাইলিনকে অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায় চিনে পাঠানো হয়। কিন্তু, অসমীয় স্বামী ছিলেন মাকুমেই। দু’জনের আর কখনও দেখা হয়নি। আট বছর বয়সী মিংকেও বাবা-মার সঙ্গে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখনই রীতাদেবী জানতে পারেন হংকং, কানাডা বা চিনে চলে যাওয়া মাকুমের পুরনো বাসিন্দারা এখনও বছরে একদিন মিলিত হন। শাড়ি পরেন, অসমীয়া, হিন্দিতে কথা বলেন। বলিউডি গানের সঙ্গে নাচেন।
মাকুম বইটির সূত্র ধরেই স্থানীয় সাহিত্য সভা, আসু-সহ সব সংগঠন পুরনো ভুল শোধরাতে উদ্যোগী হয়েছে। ৪৮ বছর পর, গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনিসুকিয়ার মাকুমে ফের মিলিত হন নানা দেশের ১১২ জন প্রাক্তন মাকুম-বাসী। তার রেশ টেনেই, এ বার হংকং থেকে মিং-এর নেতৃত্বে মাকুম এসেছেন হো মান হিং, হো ইয়ুক মুই, হো ফুং ওই, চান ইউয়েত হো, ফুং কান ওয়ান, হো চোই ফাং। হিং ছাড়া সকলেই মহিলা। মিং-এর মা পার্বতী গোয়ালা মাকুম উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। মিং-এর ভারতীয় নাম ছিল অঞ্জলি গোয়ালা! বাবা ছিলেন হো কং ওয়া। গুয়াহাটি থেকে প্রথমে শিলং-এ বসবাসকরী কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন মিং রা। তারপরে পাড়ি দেন জন্মভূমিতে।
অসমের স্মৃতিকে টাটকা রাখতে অঞ্জলি তথা মিং ছেলের নাম রেখেছেন রাহুল গোয়ালা। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, অসমে জন্মানোর প্রমাণপত্র তাঁর কাছে নেই। তিনি মাকুম তথা অসমবাসীর কাছে ভারতের মাটিতে জন্মের প্রমাণ হিসাবে যে কোনও উপায়ে শংসাপত্র জোগাড়ের আবেদন জানান। জন্মস্থানের টানে হংকং থেকে আসা সাতজনকে তিনিসুকিয়ার ‘যুগলকিশোর কেষান ভবনে’ সম্বর্ধনা জানানো হয়। সেখানে হাজির থাকা পুরনো দিনের বন্ধু-বান্ধবীরা মিং, হিং, ফুং, ফাং, মুইদের বুকে টেনে নেন। |
|
|
|
|
|