মধ্যবিত্তের মেকওভার
ভুতেদের পর!অনীক দত্ত-র নতুন ছবির বিষয় মধ্যবিত্ত বাঙালি। লিখছেন পরিচালক নিজেই আমি ছোটবেলায় যে অঞ্চলে বড় হয়ে উঠেছি, দু’একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারকে বাদ দিলে সেখানে ছিল মূলত মধ্যবিত্তের আস্তানা। আমাদের রাস্তায় যে ক’টা একতলা, দোতলা বা বড়জোর তিনতলা বাড়ি ছিল, সে রকম গোটা কুড়ি বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে মাত্র দু’তিন জন ছিলেন গাড়ির মালিক। এখন সেই রাস্তাটা দিয়ে যেতে গেলে দেখা যাবে কিছু মাঝারি বহুতল এবং গ্যারেজের বাইরেও রাস্তার দু’দিকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির লাইন।
তা হলে এই সব লোক বা তাঁদের উত্তরসূরিরা কি এ ক’বছরে হঠাৎ বিত্তবান হয়ে উঠলেন! ব্যাপারটা হয়তো এত সহজ নয়। গত দু’দশক ধরে বাঙালি মধ্যবিত্তের যে মানসিক এবং বাহ্যিক ভাবে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, এটা হয়তো তার একটা ছোট্ট নমুনামাত্র।
ফিরে যাই চলুন ৭০ বা ৮০-র দশকে। সেই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালির চেহারা-ছবি, বেশভূষা, স্বভাব, মেজাজ, প্রিঅকুপেশন, জীবনধারা, রাজনৈতিক-ধার্মিক বা অন্যান্য বিশ্বাস ঠিক কী রকমটা ছিল?
একজন কুইন্টএসেনশিয়াল মিডল ক্লাস বাঙালির প্রোটোটাইপ বলতে আমরা বুঝতাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে কালো মোটা ফ্রেমের শেলের চশমা, আপিসের বাইরে খদ্দরের পাঞ্জাবি বা সুতির বুশ শার্ট, পায়ে চটি। মহিলাদের অধিকাংশের নিত্য পরিধেয় ছিল তাঁতের শাড়ি বা বড়জোর আন্ডারস্টেটেড সালোয়ার কামিজ। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি একটা মার্জিত রুচির ছাপ পাওয়া যেত। তাঁদের মধ্যে অস্টেনটেশাস ব্যাপার কম ছিল। মেজাজেও তাঁরা ছিলেন খানিক অলস প্রকৃতির। আড্ডাবাজ বলেও দুর্নাম ছিল তাঁদের। এঁদের কেউ কেউ ছিলেন একেবারে পেশাদার আড্ডাবাজ, যাঁরা এখন বিপন্নপ্রায় প্রজাতি বলা যায়। এঁরা রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সিনেমা-থিয়েটার-গান বা খেলাধুলো নিয়ে অনর্গল চর্চা করে যেতে পারতেন পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে বা গলির রকে বসে।
এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইংরাজি ভাষায় দক্ষ হলেও ছিলেন ঘোরতর বাঙালি। বাংলা ভাষায় খুবই সাবলীল এবং কিছু ক্ষেত্রে এঁদের কথাবার্তায় অত্যন্ত সুচিন্তিত শব্দচয়ন লক্ষ করা যেত। বাঙালিদের কর্মবিমুখ বলে একটা অপবাদ ছিল। অ্যাম্বিশনের অভাব এবং জাগতিক চাহিদাগুলো কিছুটা কম ছিল। মানি ওয়াজ আ ডার্টি ওয়ার্ড ভোগবাদের ব্যাপারে কিছুটা অনীহা লক্ষ করা যেত। ‘হাই থিঙ্কিং’ ছিল কি না জানি না, তবে ‘সিম্পল লিভিং’-এর একটা ব্যাপার ছিল। এঁদের প্রত্যেকেরই বিভিন্ন বিষয়ে খুব জোরদার মতামত থাকত। রাজনৈতিক বিশ্বাস বিভিন্ন হলেও একটা বড় অংশের মধ্যে একটা বাম-ঘেঁষা মনোভাব ছিল। যাঁরা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তাঁদের মধ্যেও।
ভারতের অন্যান্য মিডল ক্লাসের অনুপাতে এখানে ঈশ্বরবিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কিছুটা কম লক্ষ করা যেত। নিজেদের যুক্তিবাদী বলে অনেকেই মনে করতেন এবং একটা ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার’ বলা যায় একটা বিজ্ঞানমনস্কতা কিছু ক্ষেত্রে কাজ করত। কলকাতা শহরটার মতো এই লোকগুলোর একটা জোরদার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা স্ট্রং ক্যারেক্টার ছিল যা অন্য প্রদেশের লোকেদের থেকে কিছুটা আলাদা।
কালের নিয়মে বদল অবশ্যম্ভাবী। পরিবর্তন আসবেই। রাজনৈতিক ‘পরিবর্তন’ আসুক বা না আসুক, এই বাঙালি মিডলক্লাসের চেহারা-চরিত্র আজ অন্য রকম। কতটা অন্য রকম?
বাইরে থেকে দেখলে তফাতটা স্পষ্ট দেখা যায়। এঁদের মধ্যে এখন ওয়েল-গ্রুমড হওয়ার একটা প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে তাঁদের ফ্যাশন ভিকটিমে পরিণত করেছে পাশ্চাত্ত্যের ট্রেন্ডগুলোকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে। এমনকী স্বজাতীয় জামাকাপড়গুলোও অনেক ক্ষেত্রে গ্যারিশ হয়ে উঠেছে। চিত্রবিচিত্র কারুকার্যমণ্ডিত পাঞ্জাবি এবং লাল রঙের ধুতিও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এঁরা দামি ব্র্যান্ডের জামাকাপড়, অ্যাকসেসরিজ সাধ্যের মধ্যে না হলেও পরাটা আবশ্যিক বলে মনে করেন। এঁদের মধ্যে আয়ের একটা বড় অংশ খরচ করার প্রবণতা দেখা যায়। গত দু’দশকে আসা বিশ্বায়ন, বাজার-অর্থনীতির দৌলতে চতুর্দিকে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন শপিং মলে দিশি-বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের উপস্থিতি, ক্রেডিট কার্ডের দ্বারা অনেক পণ্যসামগ্রীর সহজলভ্য হওয়া তাঁদের এই পণ্যবাদকে অনেকটা ইন্ধন জুুগিয়েছে। দামি রেস্তোরাঁতে ইটিং-আউট বা নাইটক্লাবগুলোতে অঢেল পয়সা খরচ করতে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেপুলেরা এখন আর পিছপা হয় না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর দৌলতে, কল সেন্টার বা অন্য সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি যা গজিয়ে উঠেছে সেই সুবাদে বাঙালি অল্পবয়সি ছেলেপুলেদের পকেটে কিছু পয়সা এসেছে। তাঁরা ইচ্ছেমতো সেই পয়সার দেখনদারি করার বা ছড়ানোর সুযোগটা মোটেই হাতছাড়া করতে চায় না। আজকের ভোগবাদী সমাজ তাঁদের আকাঙ্ক্ষা বা লোভের মাত্রা বাড়ানোর যথেষ্ট রসদের জোগান দিচ্ছে। আজকের বাঙালি অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অনেকে মনে করেন বাঙালি মধ্যবিত্ত এখন অনেক বেশি ডায়নামিক, অ্যাম্বিশাস। তাঁরা এখন পশ্চিমবঙ্গে বা তার বাইরে চাকরি করে ভাল অর্থোপার্জন করছেন। কেউ কেউ পুরনো দুর্নাম ঘুচিয়ে ব্যবসাতেও বেশ সফল। একটা ধারণা চালু হয়েছে বাঙালি এখন আর তেমন ‘আঞ্চলিক’ নেই। তাঁরা শুধু ‘জাতীয়’ও নয়, ‘আন্তর্জাতিক’। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
অনেকের আবার উল্টো মত। বাঙালি নাকি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সারা দেশে বা বিশ্বে যে ভুবনায়নের নামে একটা হোমোজিনাইজিং পদ্ধতি চালু হয়েছে, তারই শিকার। তাঁদের মতে আগে বাঙালি মধ্যবিত্ত ছিল অনেক প্রগতিশীল। এখন বরং তাঁরা অনেক পিছিয়ে। বলা যায় রিগ্রেসিভ বা রেট্রোগ্রেসিভ। নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখাটা প্রাদেশিকতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ইংরাজি বুলি আওড়ালেই (যার কিছু মার্কিনি প্রভাবান্বিত ভুলভাল অপপ্রয়োগ) আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না। বাঙালির মধ্যে নাকি বেঙ্গল রেঁনেসার থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য যুক্তিবাদী মনের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। বরং সে হয়ে উঠছে কিছুটা মৌলবাদী এবং অতিভক্তির দোষে দুষ্ট।
তবে এ সবেরই অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। ব্যতিক্রমই নিয়ম প্রমাণ করে। একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে আমার লেখাটা শেষ করছি। কলেজজীবনে আমি একটা চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা মারতে যেতাম। সেখানে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা ক্রস-সেকশনকে দেখা যেত। এখানে অনেক নামীদামি সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, চিত্রপরিচালক এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর পর্দাপণ ঘটত। এখানে আমরা দু’তিন টাকা দামের লেবু চা বা কালেভদ্রে এক প্লেট পকোড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম এবং কিছু হালকা বা মনোজ্ঞ আলোচনায় অনেক কিছু জানতে পারতাম। দোকানের মালিক ছিলেন খুব ‘মাই ডিয়ার’ লোক। খুব কম ট্যাঁকের কড়ি খরচা করে আমরা যে টেবিলগুলো অনেক্ষণ দখল করে রাখতাম, তাতেও কোনও আপত্তি করতেন না। কখনও হয়তো আমাদের আড্ডাতেও যোগ দিতেন। এই ভদ্রলোককে পরবর্তী কালে আমি আমার বিজ্ঞাপনের ছবিতে কয়েক বার ব্যবহার করেছি। দোকানটা এখন আর নেই। এই ধরনের চায়ের দোকানগুলোও উত্তর কলকাতার দু’একটা বাদ দিলে বেশির ভাগই উঠে গিয়েছে। তার বদলে এখন বাঙালি ছেলেপুলেরা সময় কাটাতে যায় বাহারি সব কাফেটেরিয়াগুলোতে। বেশির ভাগই কিছু নামী ফ্র্যাঞ্চাইজি চেনের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে চা-কফি বা তার সঙ্গে যে স্ন্যাক্স পাওয়া যায়, তার দাম মারাত্মক বেশি। এই দোকানগুলোতে সর্বক্ষণ উচ্চগ্রামে একই ধরনের গান বাজছে। এই সব জায়গাগুলোতে বসে এই ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে আড্ডা মারেই বা কী করে, আর প্রেমই বা করে কী করে! আমাদের বাড়ির পাশেই আছে এমন একটা কেতাদুরস্ত কফিশপ। আমি একদিন সেখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের ঠিক পিছনে বসেছিল এক ইয়াং কাপল। এই দোকানটার ঠিক উপরে বিমানসেবিকা তৈরি করার এক ইনস্টিটিউট রয়েছে। সেখানে খুব সাধারণ ঘরের মেয়েরা, এমনকী মফস্সল থেকেও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিতে এসে পৌঁছয়। যিনি আমার গাড়ি চালাতেন, এমনকী তিনিও সর্বস্ব দিয়ে তাঁর কন্যাকে এখানে পাঠানোর প্ল্যান এঁটেছিলেন। আমি যে কপোত-কপোতীর কথা বলছি, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন এই ফিনিশিং স্কুলের ছাত্রী। আর অন্য জন স্পষ্টতই তাঁর বয়ফ্রেন্ড। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এ সব দামি জায়গায় আসার রেস্ত পায় কোথায় এঁরা? আমি আমার মোবাইলটা পিছনের চার্জিং স্টেশনে লাগিয়ে রেখেছিলাম। কাজ শেষ হওয়ার পর দেখলাম সেলফোনটা উধাও। তার সঙ্গে ছেলেমেয়ে দু’টোও। এটা আরেকটা অ্যাঙ্গেল। অতিরিক্ত চাহিদা এবং সেটা পূরণ করার অক্ষমতা থেকে মধ্যবিত্তের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে একটা অপরাধপ্রবণতা। যদিও তাঁদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা এখনও টনটনে। নানা রকম ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছে ‘ভদ্রঘর’ থেকে আসা কর্মচারীও। আয়ের অসঙ্গতি থেকেই সমাজের সব ক্ষেত্রে এই ধরনের বিকার লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে তা অন্য প্রসঙ্গ।
মোটামুটি ভাবে বলা যেতে পারে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা মেক ওভার হয়েছে। ভাল না খারাপ, ঠিক না বেঠিক, এই মূল্যায়নের মধ্যে আর যাচ্ছি না। আমার পরবর্তী ছবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প অনুপ্রাণিত ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ যা খুব শিগগির মুক্তি পাবে। তাতে একটি সহজ সরল গল্পের মাধ্যমে, কিছুটা হালকাচ্ছলে উপরোক্ত বিষয়টিকে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। সমকালীন ভোগবাদী সমাজের প্রেক্ষাপটে এক আধুনিক আলাদিনের গল্প। এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত লোক, হঠাৎ খুঁজে পাওয়া প্রদীপ এবং তার থেকে আবির্ভূত দৈত্যের কল্যাণে তাঁর অচরিতার্থ কামনা-বাসনাগুলোকে পেতে চাওয়ার গল্প। তাঁর সেই ইচ্ছে শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে কি না, তা দেখতে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.