|
|
|
|
শিকড়ের টানে তসলিমা |
তাই ‘দুঃসহবাস’। গতানুগতিকতার বিপরীতে ভেসে যাওয়া,
স্বাধীনচেতা নারী টিভির পরদায়। লিখছেন কৃশানু ভট্টাচার্য |
তিনি মুখ খুললেই বিতর্ক। কলম ধরলেই সমালোচনার ঝড়। বাংলা সমাজ ও রাজনীতিতে বহু আলোচিত তসলিমা নাসরিন এ বার বাংলা টিভি চ্যানেলে ঝড় তোলার অপেক্ষায়।
কী সেই ঝড়? “ভারতীয় টিভি-র পর্দায় সর্বদাই দেখি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জাঁতাকলে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া প্রতিবাদহীন মেয়েদের। ‘সাবমিশন’-ই যেন ভারতীয় টেলিসিরিয়ালের মেয়েদের ভবিতব্য। বাস্তবেও। কেন?” দিল্লি থেকে দূরভাষে ভেসে আসে সেই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
গতানুগতিকতার বিপরীত স্রোতে ভেসে যাওয়া, স্বাধীনচেতা যে-নারী রূপে গোটা বিশ্ব চেনে তাঁকে, তেমনই তিনটি মেয়ের কাহিনি নিয়ে তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘দুঃসহবাস’ ধারাবাহিক হিসেবে শুরু হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে আকাশ ৮ চ্যানেলে। চ্যানেলের আশা, এই ধারাবাহিক আমজনতার প্রত্যাশা পূরণে সফল হবে।
চার বছর হল কলকাতা শহরে প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন তসলিমা। কিন্তু তাতে কী? তিনি আছেন তাঁর মতো করে। প্রবল ভাবেই। “সবাই চেষ্টা করেছিল আমাকে উপড়ে ফেলে দিতে এই শহর থেকে। কিন্তু পারেনি। আজও এখানে শিকড়ের টান অনুভব করি। আমার লেখালেখির মাধ্যমে আমি বেঁচে আছি এই শহরে,” গর্জে ওঠেন তিনি।
বিতর্ক আর তসলিমা যেমন সমার্থক, এই ধারাবাহিকও কি শুরু থেকেই উসকে দেবে তেমন বিতর্ক? “কেউ যেন এই ধারাবাহিককে আমার জীবনী না ভাবেন,” সতর্ক করেন তসলিমা।
জি বাংলা আর স্টার জলসার সঙ্গে টিআরপি-র লড়াইয়ে টিকে থাকার লক্ষ্যেই কি আকাশ আটের তুরুপের তাস হতে চলেছেন তসলিমা?
“আসলে আমাদের নতুন চ্যানেলের জন্য নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদ থেকেই আমরা বেছে নিয়েছি তসলিমাজির কাহিনি”, অকপট স্কীকারোক্তি আকাশ ৮-এর প্রযোজক ঈশিতা সুরানার। |
|
তাঁর মনে হয়েছে, অন্যান্য চ্যানেলে কাল্পনিক ধারাবাহিক দেখতে অভ্যস্ত দর্শকদের যদি তাঁরা আসল জীবনের কাহিনি দেখাতে পারেন, অনেকটা বিদেশের চ্যানেলের ধাঁচে, তা হলে একটা হইচই ফেলা যাবে।
তাঁর ধারণা, আজকের বাঙালি সমাজের নতুন এবং অত্যাধুনিক প্রজন্মকে ছোট পর্দায় টেনে আনতে হলে আজকের জীবনযাপনের যে-যন্ত্রণা, তা-ই ফুটিয়ে তুলতে হবে ধারাবাহিকে। গতানুগতিকতার বিপরীতে সাঁতার কাটতে হবে। তাই তো? “অবশ্যই”, মন্তব্য করেন তিনি। ‘দুঃসহবাস’ পরিচালনার অনেক আগেই তসলিমার কাহিনি নিয়ে ২৬ পর্বে ধারাবাহিক ‘ঝুমুর’ তৈরি করেছিলেন পরিচালক সুশান্ত বসু। “টিআরপি উঠেছিল দেখার মতো” তাঁর দাবি।
জি বাংলা বা স্টার জলসার পালের হাওয়া কাড়ার জন্যই কি এই নতুন চ্যানেলের জন্য বেছে নিয়েছেন তসলিমার বিতর্কিত কাহিনি?
জবাবে সতর্ক সুশান্তবাবু। “অন্য চ্যানেলের পালের হাওয়া কাড়তে পারব কিনা জানি না। তবে আকাশ ৮-কে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার জন্য পরিচালক হিসেবে আমাকে চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। দেখা যাক।”
বিদেশের ধাঁচে ‘রিয়াল-লাইফ বেসড’ কাহিনি তৈরি করে নতুন চ্যানেলের ধারাবাহিককে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার ভাবনার ফসল কি এই পৌষে ঘরে তুলতে পারবে ‘দুঃসহবাস’? আশায় ঈশিতা। টিআরপি-র প্রশ্নে অকপট তিনিও। “একটা অঙ্ক তো চ্যানেলকে কষতেই হয়,” জানালেন ঈশিতা।
ঈশিতার মতে, এই ধারাবাহিকের কাহিনি অনেকটাই ‘এক্সপিরিয়েন্স অব তসলিমা’। ‘ঢাকা আর কলকাতার জন্য আমার টান সমান,” বললেন তসলিমা। কথায় কথায় জানালেন, এখানকার রাস্তাঘাট চেনেন হাতের তালুর মতোই। কলকাতার সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজনের প্রায় সবাইকে চেনেন। “এ পার বাংলার লেখকদের উপন্যাস পড়ছি সেই ছোট থেকেই। ‘আনন্দ পুরস্কার’ পেয়েছি সাহিত্যের জন্য। এই শহর আমার।”
তাঁর আক্ষেপ, অথচ সেই শহর থেকেই তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। চার বছর আগের ঘটনার ব্যথায় এখনও সমান কাতর তসলিমা।
“‘দুঃসহবাস’-এর কাহিনি যেন তসলিমার চোখ দিয়ে সমাজকে দেখা,” দাবি করলেন সুশান্তবাবু। “কলকাতায় থাকতে না-পারার দুঃখ তলসিমা কী ভাবে ভুলতে চান জানেন? উনি আমাকে বলেছেন, যখন এই ধারাবাহিকের সম্প্রচার চলবে, তখন মনে করব, আমি কলকাতাতেই আছি!”
উত্তর কলকাতার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন স্বাধীনচেতা মেয়ের কাহিনি নিয়ে ‘দুঃসহবাস’। বিভিন্ন ভূমিকায় আছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, অনুরাধা রায়, চান্দ্রেয়ী, বৈশাখী মার্জিত, পীযূষ, সমতা, জয়জিৎ প্রমুখ।
পরিবারের বড় মেয়ে চান্দ্রেয়ী স্বাধীনচেতা, কালো বলে বিয়ে হয় না বাড়ির মেজ মেয়ে বৈশাখীর। আর ছোট বোন সমতা কোনও কিছুই মানে না। “এক ছাদের নীচে থাকার ফলে বোঝা যায়, সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে,” মন্তব্য করেন সুশান্তবাবু। “এই পরিবারের কর্তা আমি। কাজ করে আনন্দ পেয়েছি, কাহিনির মধ্যে টার্ন আছে,” মন্তব্য বিশ্বজিৎবাবুর। “আসলে শর্টস পরলে আর সিগারেট খেলেই মেয়েরা প্রগতিশীল হয় না। যে-মেয়েদের আমি দেখাচ্ছি, তারা চিন্তাভাবনায় আর মননে স্বাধীন, প্রগতিশীল। পোশাকের জন্য নয়,” মন্তব্য করলেন তসলিমা।
কাহিনিকার ছাড়াও এই ধারাবাহিকে তিনি কী ভাবে আছেন? “ধারাবাহিকের এক জায়গায় আমি আছি। এই জায়গাটা বেশ ‘ইন্টারেস্টিং’।” ‘লজ্জা’ উপন্যাসে সুরঞ্জন ছিল ঢাকার ছেলে। এই ধারাবাহিকে দেখানো হয়, সে চলে আসে কলকাতায়। আলাপ হয় একটি মেয়ের সঙ্গে। তাকে কথাপ্রসঙ্গে সুরঞ্জন জানায়, ‘লজ্জা’ উপন্যাসে তসলিমা নাসরিন তার কথা লিখেছেন। “এই ভাবেই আমি আছি এই ধারাবাহিকে”, জানালেন তসলিমা। “একটি কথা অবশ্যই লিখবেন, পাকাপাকি ভাবে আমি থাকতে চেয়েছিলাম আমার প্রিয় শহর কলকাতায়। সংসার পেতেছিলাম। কিন্তু যত দিন কলকাতায় আমার লেখালেখি ছাপা হবে, আমার কাহিনি নিয়ে নাটক-সিরিয়াল তৈরি হবে, তত দিন ওই শহরে আমি বেঁচে থাকব,” বললেন তসলিমা। দিন কয়েক পরেই উড়ে যাবেন ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে লেকচার দিতে। কিন্তু ব্যস্ত জীবনেও তাঁর মন হু হু করে কলকাতার জন্য। আর কি কোনও দিন এখানে ফিরতে পারবেন?
জানেন না তসলিমাও। |
|
|
|
|
|